সোমবার, ৩ জুন ২০২৪

পবিত্র ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য, শিক্ষা ও গুরুত্ব

 গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
প্রকাশিত
 গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
প্রকাশিত : ৯ এপ্রিল, ২০২৪ ১৭:০০

মুসলমানদের জীবনে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর। এই দিনটির তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। প্রিয় পাঠক আমি অধম চেষ্টা করব ঈদুল ফিতরের বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করার এবং একজন রোজাদার ব্যক্তির রোজা, ইবাদত-বন্দেগিগুলো পরিশুদ্ধভাবে আল্লাহতায়ালার দরবারে কবুল হওয়ার জন্য সঠিকভাবে তুলে ধরতে- ইনশাআল্লাহ।

ঈদুল ফিতর: ঈদুল ফিতর শব্দটি ‘আওদ’ শব্দমূল থেকে উদ্ভূত। এর আভিধানিক অর্থ হলো ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা, বারবার আসা। আর ফিতর শব্দের অর্থ হলো ফাটল, ভেঙে ফেলা, বিদীর্ণ করা। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর শাওয়ালের চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে রোজা ভেঙে ফেলা হয় বলে এ দিনটিকে ঈদুল ফিতর বলা হয়।

ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য ও করণীয়:

মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন: ‘আর যেন তোমরা নির্ধারিত সংখ্যা পূরণ করতে পার এবং তোমাদেরকে যে সুপথ দেখিয়েছেন, তার জন্য তোমরা আল্লাহর মমত্ব-বড়ত্ব প্রকাশ কর এবং তার কৃতজ্ঞ হও।’ (বাকারা-১৮৫)।

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ঈদুল ফিতরের দিন যখন আসে তখন আল্লাহতায়ালা রোজাদারদের পক্ষে গর্ব করে ফেরেশতাদেরকে বলেন, হে আমার ফেরেশতাগণ তোমরাই বলো রোজাদারদের রোজার বিনিময়ে আজকের এই দিন কি প্রতিদান দেওয়া যেতে পারে? সেই সমস্ত রোজাদার, যারা তাদের দায়িত্ব পুরোপুরি আদায় করেছে, তখন ফেরেশতারা আল্লাহকে বলেন, হে দয়াময় আল্লাহ উপযুক্ত উত্তম প্রতিদান তাদের দান করুন । কারণ তারা দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা করেছেন, প্রাপ্য পারিশ্রমিক তাদেরকে দান করুন।

তখন আল্লাহতায়ালা রোজাদারদের বলতে থাকেন, ‘হে আমার বান্দা তোমরা যারা যথাযথভাবে রোজা পালন করেছ, তারাবিহর নামাজ পড়েছ, তোমরা তাড়াতাড়ি ঈদগাহ মাঠে ঈদের নামাজ পড়ার জন্য যাও এবং তোমরা তোমাদের প্রতিদান গ্রহণ করো । ঈদের নামাজের শেষে আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, হে আমার প্রিয় বান্দারা আমি আজকের এ দিনে তোমাদের সব পাপ পুণ্যের দ্বারা পরিবর্তন করে দিলাম । অতএব তোমরা নিষ্পাপ হয়ে বাড়িতে ফিরে যাও’। (বায়হাকি ও মিশকাত)

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন: “আল্লাহ এই দুটি দিনের পরিবর্তে অন্য দুটি দিন তোমাদের উৎসব করার জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তার একটি হল ‘ঈদুল ফিতর’, অন্যটি ‘ঈদুল আজহা’। তোমরা পবিত্রতার সঙ্গে এ দুটি উৎসব পালন করবে।’’ (আবু দাউদ ও নাসায়ি)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: এদিনটিতে তোমরা রোজা রেখো না। এ দিন তোমাদের জন্য আনন্দ-উৎসবের দিন। খাওয়া, পান করা আর পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে আনন্দ-উৎসব করার দিন। আল্লাহকে স্মরণ করার দিন (মুসনাদ আহমাদ, ইবনু হিববান)।

রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ঈদের আনন্দ শুধু তাদের জন্য যারা রমজানের রোজা তারাবিহর নামাজসহ আল্লাহতায়ালার যাবতীয় বিধিবিধান গুরুত্ব সহকারে আদায় করেছে । আর যারা রমজানের রোজা ও তারাবিহ আদায় করেনি তাদের জন্য ঈদের আনন্দ নেই, বরং তাদের জন্য ঈদ তথা আনন্দ অগ্নিশিখা সমতুল্য।’ (বুখারি)।

ঈদের রাতের ফজিলত: হজরত আবু উমামা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে আল্লাহর নিকট সাওয়াব প্রাপ্তির নিয়তে ইবাদত করবে তার হৃদয় সে দিনও জীবিত থাকবে, যেদিন সব হৃদয়ের মৃত্যু ঘটবে। (ইবন মাজাহ, হাদিস নম্বর ১৭৮২, আল মুজামুল আওসাত, হাদিস নম্বর-১৫৯)।

মহানবী সা. আরও ইরশাদ করেন ‘যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে পুণ্যের প্রত্যাশায় ইবাদত-বন্দেগি করে কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তির জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার, অর্থাৎ কিয়ামতের দিন অন্যান্য লোকদের অন্তর মরে যাবে, কিন্তু কেবল সেই ব্যক্তির অন্তর জীবিত থাকবে, সে দিনও মরবে না’। (আততারগিব)।

রাসুল সা. ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি পুণ্যময় ৫টি রাতে ইবাদত-বন্দেগি করে সেই ব্যক্তির জন্য সু-সংবাদ রয়েছে, আর সেই সুসংবাদটি হচ্ছে ‘জান্নাত’ এবং পুণ্যময় ৫টি রাত হলো ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, শবেবরাত, জিলহজের রাত, আরাফাতের রাত । (বায়হাকি) ।

ঈদের নামাজের সময়সীমা: সূর্য আনুমানিক তিন গজ পরিমাণ ওপরে ওঠার পর অর্থাৎ সূর্যোদয়ের ২৩/২৪ মিনিট পর থেকে দ্বি-প্রহরের পূর্ব পর্যন্ত ঈদের নামাজের ওয়াক্ত। সূর্য তিন গজ পরিমাণ ওপরে ওঠা পর্যন্ত সময়টুকুকে তার উদয়কাল বলে গণ্য করা হয়। এ সময়ে কোনো নামাজ পড়া জায়েজ নেই। ঈদুল ফিতরের নামাজ অপেক্ষাকৃত বিলম্বে এবং ঈদুল আজহার নামাজ আগে আদায় করা উত্তম।

বৃষ্টির কারণে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়া জায়েজ কি না। হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার ঈদের দিনে বৃষ্টি হলো, তখন রাসুল (স.) তাদেরকে নিয়ে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়লেন। (আবু দাউদ-১১৬২)। এতে বোঝা যায়, বৃষ্টি বা অন্য কোনো যুক্তিসংগত কারণ থাকলে ঈদের নামাজ মসজিদে পড়া জায়েজ।

নামাজের জন্য ঈদগাহের দিকে রওয়ানা হওয়ার আগে ৩টি, ৫টি এরকম বেজোড় সংখ্যক খেজুর খাওয়া সুন্নত। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন, প্রিয়নবী (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন সকালে বেজোড়সংখ্যক খেজুর খেতেন। (আদ-দুরূসুর রামাদানিয়াহ, পৃ. ১৮৫।)

আসুন এক নজরে জেনে নেই ঈদের সুন্নতগুলো:

১। অন্য দিনের তুলনায় আগে আগে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া।

২। গোসল করা।

৩। শরিয়তসম্মত সাজসজ্জা গ্রহণ করা।

৪। সুগন্ধি ব্যবহার করা।

৫। ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে মিষ্টি জাতীয় আহার (যেমন খেজুর) গ্রহণ করা।

৬। সকাল সকাল ঈদগাহে যাওয়া।

৭। ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাওয়ার আগে সাদকাতুল ফিতরা আদায় করা।

৮। সম্ভব হলে এক রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে যাওয়া এবং অন্য রাস্তা দিয়ে ঈদগাহ থেকে ফিরে আসা।

৯। পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া।

১০। ঈদগাহে যাওয়ার সময় নিম্নোক্ত তাকবির পাঠ করা:

(আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।)

ঈদের দিনে শুভেচ্ছা বিনিময়: হাফেজ ইবনে হাজার (রহ.) বলেন, ‘যুবাইর ইবনে নফির থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত, রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময় সাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন, (তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম) অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন। (ফাতহুল বারী শরহু সহীহিল বুখারি ৬/২৩৯, আসসুনানুল কুবরা লিলবাইহাকী, হাদীস-৬৫২১)।

সাদকায়ে ফিতর আদায়: রমজান মাসের রোজার ভুলত্রুটি দূর করার জন্য ঈদের দিন অভাবী বা দুস্থদের কাছে অর্থ প্রদান করা হয়, যেটিকে ফিতরা বলা হয়ে থাকে। এটি প্রদান করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী- ‘তুহরাতুল্লিস সায়িম’ অর্থাৎ এক মাস সিয়াম সাধনায় মুমিনের অনাকাঙ্ক্ষিত ত্রুটি-বিচ্যুতির কাফফারা হলো সাদকায়ে ফিতর।

ঈদের নামাজের পূর্বেই ফিতরা আদায় করার বিধান রয়েছে। তবে ভুলক্রমে নামাজ আদায় হয়ে গেলেও ফিতরা আদায় করার নির্দেশ ইসলামে রয়েছে। সাদাকাতুল ফিতরবিষয়ক হাদিসগুলোতে পাঁচ ধরনের খাদ্যদ্রব্যের উল্লেখ রয়েছে : গম, যব, খেজুর, কিশমিশ, পনির। সাদকায়ে ফিতরের গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে পরিশুদ্ধ হয় ৷’ (সুরা আলা : আয়াত ১৪)।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, গোলাম, স্বাধীন, পুরুষ, নারী, ছোট, বড় সব মুসলিমের ওপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ‘সা’ খেজুর, অথবা অর্ধ ‘সা’ গম জাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন এবং (ঈদের) নামাজের আগে তা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন’ (বুখারি ও মুসলিম)। এবার রাষ্ট্রের পক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশন মাথাপিছু ফিতরা ধার্য করেছে সর্বনিম্ন ১১৫ টাকা এবং সর্বোচ্চ ২ হাজার ৯৭০ টাকা।

ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও শিক্ষা অপরিসীম। প্রত্যেক মুসলমানের জীবনে ধর্মীয় করণীয়গুলো পালনের মাধ্যমে নিজেকে একজন প্রকৃত মুমিন মুসলমান হিসেবে তৈরি করা জরুরি। পরিশেষে কামনা প্রত্যেক রোজাদার ব্যক্তির রোজা, সাহরি, ইফতার, তারাবি, ইবাদত- বন্দেগি, দান-সাদকা মহান আল্লাহতায়ালা কবুল করুন। আমিন। সবাইকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা ও ঈদ মোবারক।।

লেখক : ধর্ম ও সমাজ সচেতন লেখক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপস্থাপক ও চেয়ারম্যান, গাউছিয়া ইসলামিক মিশন, কুমিল্লা।


মৌসুমি আম নিয়ে আতঙ্ক নয়, প্রাণভরে খান

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
কৃষিবিদ মো. বশিরুল ইসলাম

জ্যৈষ্ঠ মাস। এ মাসে শহর কিংবা গ্রামের বাজারগুলোতে দেখা যায় নানা রকম ফলের সমারোহ। চারদিকে নানা রকম ফলের সুবাস। গ্রাম-বাংলার এসব ফলে ছেয়ে গেছে শহরের অলিগলি ও বাজার। বছরের আর কোনো মাসে এত ফলের আগমন ঘটে না। তাই তো ভুল করে অনেকে জ্যৈষ্ঠ মাসকেই ‘মধুমাস’ বলে ফেলেন। আমরাও অপেক্ষায় থাকি কখন জ্যৈষ্ঠ মাস আসবে। কারণ এ সময়েই আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, জামরুলসহ নানা জাতের ফল পাকতে শুরু করে। গাছ থেকে সদ্য পেড়ে আনা তাজা ফলের পরশ অসাধারণ এক অনুভূতির জন্ম দেয়। এই ফলের কথা ভেবে নস্টালজিক হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক।

ফলের রাজা আম। কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল। বর্তমান সরকার আমগাছকে দিয়েছে জাতীয় গাছের মর্যাদা। যদিও কাঁঠাল জাতীয় ফল, জনপ্রিয়তায় আম সবার ওপরে। মধ্য মে থেকে উন্নত জাতের আমের মৌসুম শুরু হয়। চলে সেই প্রায় আগস্ট মাস পর্যন্ত। এর মধ্যে জুন ও জুলাই মাস আমের বাজার থাকে রমরমা। এ সময় ধনী থেকে গরিব সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে দেখা যায় ফল কেনার উৎসব। দামও থাকে সাধ্যের মধ্যে। ফলের পসরা সাজিয়ে বসে ক্ষুদ্র থেকে বড় ফল ব্যবসায়ীরা।

বছর কয়েক আগেও ফল খাওয়া নিয়ে মানুষের এত নেতিবাচক ধারণা ছিল না। গ্রাম ও শহরের মানুষ সবাই মিলে দেশীয় ফল, বিশেষ করে জুন-জুলাই মাসে আম-কাঁঠালের স্বাদ নিতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকত। আর এখন পাকা আম বাজারে এলেই নানা প্রশ্ন চলে আসে। অনেকের মধ্যেই ভয় বা বিভ্রান্তি কাজ করে। ভয়ের কারণ এগুলো খাঁটি আম তো? মানে ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড রাসায়নিক দিয়ে আম পাকানো হয়েছে কি না? এ চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। কোথাও যেন স্বস্তি নেই।

একবার ভাবুন তো সারা বছর বিদেশ থেকে এত আপেল, কমলা, নাশপাতি, স্ট্রবেরি, প্যাসন ফ্রুট, ড্রাগন ফ্রুট, আঙ্গুর, খেজুর আসে যেগুলো মাসের পর মাস পচে না। তারা কি কোনো কিছুই দেয় না? আর আমাদের দেশের চাষিদের আম কিনতে গেলে সব বিষে ভরা! আসলে, এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল আমে কেমিক্যাল ও ফরমালিন রয়েছে এমন অপপ্রচার করে আমকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া চেষ্টা করে চলছে। এতে দেশীয় আমচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

রমজান মাসে আমাদের দেশি ফল কম থাকায় বিদেশি ফলের দাম অস্বাভাবিক ছিল। ওই সময় আপেল, কমলা ও মাল্টার মতো আমদানি করা ফলের দাম কেজিতে বেড়েছিল ২০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। দাম বাড়ার জন্য বাড়তি দরে শুল্কায়ন ও ডলার সংকটকে দায়ী করেন ব্যবসায়ীরা। এখন রমজানের চেয়েও

ডলারের দাম বেশি। শুল্ক-করও এর মধ্যে কমানো হয়নি; কিন্তু ফলে ভরপুর এই মৌসুমে বাজারে আধিপত্য কমেছে বিদেশি ফলের। চাহিদা কমার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি ফলের দামও কমেছে বাজারে। এর থেকেই অনেক প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়। আর, অভিযোগ রয়েছে- আম পাকার পর তা যেন পচে না যায়, এ জন্য নিয়মিত স্প্রে করা হয় ফরমালিন। আমাদের যে ধারণা দেশি ফলমূল এবং বিদেশ থেকে আনা ফলে ফরমালিন দেওয়া হয়, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।

আমের ফরমালিন ব্যাপারে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আমার কথা হয়। তারা জানান, প্রাকৃতিকভাবেই প্রত্যেক ফলমূল ও শাকসবজিতে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় (গড়ে ৩-৬০ মিলিগ্রাম/কেজি মাত্রায়) ফরমালডিহাইড থাকে, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। মনে আছে, ২০১৪ সালে আমে ফরমালিনের কথা বলে হাজার হাজার মণ আম বিনষ্ট করা হয়েছিল। শুধু আম নয়- অন্যান্য মৌসুমি ফলও করা হয় ধ্বংস। অথচ গবেষণায় জানা গেল শুধু আম নয়, ফলমূল শাকসবজিতেও ফরমালিনের কোনো ক্ষতিকর ভূমিকা নেই। যে যন্ত্র দিয়ে ফরমালিন মাপা হতো সেটাও কার্যকর ছিল না।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এরপর ফরমালিন বিষয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে। তাতে বলা হয়- ফলমূল ও শাকসবজি হচ্ছে তন্তু (ফাইবার) জাতীয় খাবার, যেখানে প্রোটিনের উপস্থিতি অত্যন্ত কম। ফরমালিন হচ্ছে ৩৭ শতাংশ ফরমালডিহাইডের জলীয় দ্রবণ এবং অতি উদ্বায়ী একটি রাসায়নিক যৌগ যা মূলত প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবারের সঙ্গে বিক্রিয়া করে। তাই ফলমূল, শাকসবজি সংরক্ষণে ফরমালিনের কোনো ভূমিকা নেই। কেউ যদি না বুঝে দেয়ও, তাহলেও কোনো কাজে আসবে না। সংরক্ষণে কোনো ভূমিকা রাখবে না। কারণ এখানে কোনো প্রোটিন নেই।

আবার কয়েক বছর আগে যখন কার্বাইড, ইথোফেনের নামে আম ধ্বংস করা শুরু হলো তখন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের তৎকালীন চেয়ারম্যান ঘোষণা দিলেন- ইথোফেন অথবা কার্বাইড দিয়ে পাকানো আম নিরাপদ। তখন অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। আসলে, ফল পাকানোর জন্য কার্বাইড ও ইথোফেন ব্যবহার করা হয়, যা সারা বিশ্বে নির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কার্বাইড ফলের মধ্যে প্রবেশ করে না, কার্বাইড হিট উৎপন্ন করে, যা আম অথবা অন্য ফলকে পাকাতে সাহায্য করে। আর ইথোফেন কিংবা কার্বাইড দিয়ে পাকানো আমের স্বাদ কিছুটা তারতম্য মনে হলেও এর পুষ্টি উপাদানে খুব বেশি পরিবর্তন হয় না। আর ইথোফেন প্রয়োগ করা হলেও সেটা ২৪ ঘণ্টা কম সময়ের মধ্যেই নির্ধারিত মাত্রার নিচে চলে আসে। তবে যেকোনো ফল খাওয়ার আগে বেসিনের পানিতে কয়েক মিনিট ছেড়ে রাখলে কেমিক্যাল ধুয়ে চলে যায়, ফলে শরীরের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না বললেই চলে।

এবার আসুন, যুক্তি দিয়ে দেখি- আমচাষিরা ভরা মৌসুমে আসলে কেমিক্যাল ব্যবহার করে কি না? আর দিলেও কেন দেবে? আমার ধারণা, আমচাষিরা এই ধরনের কেমিক্যাল অন্তত ভরা মৌসুমে দেয় না। কারণ হচ্ছে ভরা মৌসুমে আম এমনিতেই পরিপক্ব থাকে এবং আম আধা পাকা অবস্থায় গাছ থেকে পাড়া হয়। এ সময় আম রেখে দিলে বা আমগাছ থেকে পাড়ার পর ট্রান্সপোর্টের সময়টুকুতে আম এমনিতেই পেকে যায়। তাই ভরা মৌসুমে টাকা খরচ করে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে আম পাকানোর কোনো প্রয়োজনই দেখি না।

আর ভরা মৌসুমে প্রচুর আম বিক্রি হয়, দোকানে স্টক থাকে না। প্রচুর আম আসে, তেমনি প্রচুর আম বিক্রিও হয়ে যায়। এ সময় টাকা খরচ করে কেন কেউ ফরমালিন দেবে? তবে কথা হচ্ছে, মৌসুমের শুরুতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে আম পাকাতে পারে। কারণ তখন অপরিপক্ব আম তাড়াতাড়ি পাকিয়ে বাজারে ছাড়লে বেশি দাম পাওয়া যায়।

অতিমুনাফার লোভে ব্যবসায়ীরা মৌসুমের শুরুতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে এ সময় আম পাকানোর সুযোগ নিতে পারে। আর মৌসুমের শেষে যখন বাজারে আম খুব কম পাওয়া যায়। কিছুদিন আমকে ধরে রাখতে পারলে ব্যবসায়ীরা বেশি দামে তা বিক্রি করতে পারে। ঠিক সে সময় ব্যবসায়ীরা আমে ফরমালিন দিতে পারে। তাই, পুষ্টিকর ভালো আম খেতে হলে ফলের মৌসুমেই খেতে হবে।

পরিপক্ব আম বাজারজাতে সূচি ঘোষণা করে আসছে স্থানীয় প্রশাসন। সূচি অনুযায়ী আম কিনলে কোনো ভয়ের কারণ নেই। ইতোমধ্যে সাতক্ষীরা অঞ্চলের গোবিন্দভোগ, হিমসাগর, ল্যাংড়া আম বাজারে আসতে শুরু করেছে। ১০ জুন আসবে আম্রপালি আম। আমের রাজধানী হিসেবে পরিচিত রাজশাহী অঞ্চলের গুটি আম, গোপালভোগ, রানিপছন্দ, ক্ষীরশাপাতি, লক্ষ্মণভোগ-লখনা আম বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। ১০ জুন থেকে ল্যাংড়া-ব্যানানা ম্যাংগো, ১৫ জুন থেকে আম্রপালি, ১৫ জুন থেকে ফজলি, ৫ জুলাই থেকে বারি-৪, ১০ জুলাই থেকে আশ্বিনা, ১৫ জুলাই থেকে গৌড়মতী, ২০ আগস্ট থেকে ইলামতী এবং কাটিমন ও বারি-১১ সারা বছর সংগ্রহ করা যাবে। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলতি মৌসুমে থাকছে না ম্যাংগো ক্যালেন্ডার বা আম পাড়ার সময়সীমা। আম পরিপক্ব হলেই গাছ থেকে পেড়ে বাজারজাত করতে পারবেন আমচাষিরা। আর একমাত্র আশবিহীন রংপুরের হাড়িভাঙ্গা আম পাওয়া যাবে জুন মাস থেকে।

তাই আসুন ইথোফেন, ইথিলিন ও ফরমালিনের বিষয়টি ভালোভাবে জানি এবং আম না কেনা বা ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকি। তবে আমচাষিরা যেন অতিরিক্ত মাত্রায় ইথোফেন ব্যবহার না করেন এবং তা কেবল পুষ্ট কাঁচা আমে ব্যবহার করেন, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দান ও ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

তবে কার্বাইড শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। যার কারণে নানারকম রোগ হতে পারে। যেমন- ক্যানসার, কিডনি ও লিভারের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সরকারের ব্যাপক সচেতনতামূলক প্রচারণার আর ভেজালবিরোধী নানান অভিযানের ফলে কার্বাইডের ব্যবহার অনেক কমে গেছে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে। তারপরও কিছু কাজ আমরা করতে পারি। যেমন- স্থানীয় এলাকায় মাইকিং করা, লিফলেট ও পোস্টার বিতরণ করা, আমচাষি এবং আড়তদার নিয়ে সচেতনতামূলক মিটিং করে এ ক্ষতিকারক দিকগুলো তুলে ধরতে হবে।

আম এখন সারা দেশের ফল, যা বাণিজ্যিক কৃষির কাতারে পৌঁছে গেছে। এখন উপকূলীয় লবণাক্ত ভূমিতেও মিষ্টি আমের চাষ হচ্ছে। পার্বত্য জেলার জুমচাষ এলাকায়ও উন্নত জাতের আম ফলছে। বাংলাদেশের আমের সুনাম আছে বিশ্বে। বিশ্ববাজারে আম রপ্তানির ক্ষেত্রে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, বাংলাদেশে যখন আম পাকে, তখন বিশ্ববাজারে অন্য কোনো দেশের আম আসে না। আম উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। প্রতি বছর বাংলাদেশে ১.৫ মিলিয়ন টন আম উৎপাদন হয়। সম্প্রতি ডেটা স্ট্যাটিস্টিকা এ তথ্য জানিয়েছে। দেশে প্রতি বছরই আমের উৎপাদন বাড়ছে। তাই দেশের মানুষের পুষ্টির অন্যতম উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে আম।

এ দেশ থেকে ল্যাংড়া, ফজলি, হিমসাগর, হাড়িভাঙ্গা এবং আশ্বিনা জাতের আম যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমানে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুস শহীদ জানিয়েছেন, চীন, রাশিয়া ও বেলারুশ রাজশাহীর আম নিতে আগ্রহী। দ্রুতই চীনের একটি প্রতিনিধি দল রাজশাহীর আম দেখতে আসবে। তাই এ দলটির সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলে আমের সঠিক মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কিছু কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আম, সবজি প্রভৃতি সংরক্ষণের জন্য দেশের ৮টি বিভাগে ৮টি বহুমুখী হিমাগার নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান মন্ত্রী।

তাই আসুন আমরা সবাই একটু সচেতন হই, ভালোভাবে বুঝে, সঠিকভাবে শুনে মন্তব্য করি। আমরা যদি একটু সচেতন হই তাহলে আমাদের এই সম্ভাবনাময় শিল্পকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।

লেখক: উপ-পরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়


স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাজেট ভাবনা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১’ কর্মসূচির মাধ্যমে সফলতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট ইকোনমি এই চারটি স্তম্ভ সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দিকে লক্ষ্য রেখে পথ চলছে আওয়ামী লীগ সরকার। প্রতি বছর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের সেই লক্ষ্যকে কেন্দ্র করেই স্মার্ট বাজেট ঘোষণা করে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে আগামী জুনে আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরে স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে দ্বিতীয় বাজেট ঘোষিত হতে যাচ্ছে।

তথ্য বলছে, আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে জাতীয় সংসদের বাজেটের আকার বেড়েছে। যা চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে সংশোধিত বাজেটের থেকে প্রায় ২৩ কোটি টাকা বেশি। সম্প্রতি জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত সংসদ সচিবালয় কমিশনের বৈঠকে সংসদের পরিচালন ও উন্নয়ন খাতে ৩৪৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন করেছে সংসদ সচিবালয় কমিশন। চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটে পরিচালন ও উন্নয়ন খাতে ৩২৪ কোটি ৬৭ লাখ ২১ হাজার টাকা বরাদ্দের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আগামী ৬ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেট মহান জাতীয় সংসদে পেশ করবেন। এটি বাংলাদেশের ৫৩তম বাজেট হলেও বর্তমান সরকারের ২৫তম এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল হাসান মাহমুদ আলীর প্রথম বাজেট। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের বাজেট ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের অনুমোদিত এই সুষম বাজেট নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সুষম এই বাজেটের দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ভিশন ও মিশন একটি উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে সুষম বাজেট নিয়ে আমাদের কিছু প্রত্যাশা ও ভাবনার সুযোগ রয়েছে।

বাজেট নিয়ে ভাবনার শুরুতে বলতে গেলে, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই মুহূর্তে তথ্যপ্রযুক্তিতে বিপ্লব ঘটানোর কোনো বিকল্প নেই। এ সেক্টরে বাংলাদেশ যত বেশি সমৃদ্ধ হবে স্মার্ট বাংলাদেশের পথচলা তত বেশি এগিয়ে যাবে। উল্লেখ্য, সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ রূপরেখা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বৈপ্লবিক ভূমিকা রেখেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সফল বাস্তবায়নের পর আমরা এখন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ রূপান্তরের পথে। আর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে তথ্যপ্রযুক্তি খাত। কোনোভাবে এই খাতে করারোপ করা হলে সেটি স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। এমন বিবেচনায় স্থানীয় সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার এবং তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবার প্রসার এবং সম্ভাবনাময় এই খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কর অব্যাহতির মেয়াদ বৃদ্ধি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এমতাবস্থায়, আসন্ন বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই তথ্যপ্রযুক্তি খাতের গুরুত্ব উপলব্ধি করে তাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নিশ্চিত করবে বলে প্রত্যাশা করছি।

পাশাপাশি, ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে দক্ষ জনশক্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য। যে দেশে জনশক্তি বেশি দক্ষ সে দেশ তত বেশি স্মার্ট। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের দক্ষ জনশক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ-বিবেচনায় প্রাধান্যের ভিত্তিতে তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে যেসব মানুষ পারদর্শী ও পেশাদার, তাদের কদর পৃথিবীব্যাপী বেড়েই চলেছে। তাই পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির বিষয়টি সামনে রেখে দেশে প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে। প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবলের সমন্বয়ে স্মার্ট ইকোনমির ধারণা বর্তমানে একটি পরিজ্ঞাত বিষয়। তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে ৩ লাখ মানুষ সক্রিয়ভাবে আইসিটি খাতে কর্মরত রয়েছেন। এ ছাড়া ৫ লাখ রেজিস্টার্ড ফ্রিল্যান্সার আইসিটি বিষয়ে কাজ করছেন। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে জনবহুল বাংলাদেশে বিপুল কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে প্রযুক্তির মাধ্যমেই। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি প্রয়োজন। মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন ব্যাংকিং, অনলাইনে মানি ট্রান্সফার, মোবাইল ফোনের এসএমএসের মাধ্যমে এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলন প্রভৃতি এখন বেশ জনপ্রিয়। আসন্ন বাজেটে উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের বিষয়টি অধিক গুরুত্ব পাবে বলে মনে করছি।

এ ছাড়া এমন এক পরিস্থিতিতে এই বাজেট ঘোষিত হতে যাচ্ছে যখন সারা বিশ্বই এক ধরনের মূল্যস্ফীতির ধাক্কা সামলাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে খাদ্যসংকটের মতো পরিস্থিতি চলছে। মূল্যস্ফীতির ধাক্কা আমাদের দেশেও আঘাত করেছে। বিশ্ব পরিস্থিতিও ভালো নয়। তবে বেকারত্ব এবং এর থেকে সৃষ্ট সমস্যাসমূহ বিদ্যমান। অর্থনৈতিক ক্ষতি, সেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা এবং এর পরপরই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে দ্রব্যমূল্যের বাজারে উত্তাপ এবং এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বজুড়ে। এর সঙ্গে রয়েছে বেকারত্ব দূরীকরণের উদ্যোগ হিসেবে চাকরির বাজার সৃষ্টি, শিক্ষায় অগ্রগতি বিশেষত নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা, ইত্যাদি। তার সঙ্গে রয়েছে আইএমএফের শর্ত মেনে চলা, রিজার্ভ শক্তিশালী করা এবং ডলার সংকটের বিষয়গুলো। মানুষের জীবিকায় ফেলেছে মারাত্মক প্রভাব। শিক্ষা, শিল্প, বাণিজ্য বারবার স্থবির হয়েছে। শিক্ষিত বেকারদের জন্য কর্ম পরিকল্পনা এবং বরাদ্দ প্রয়োজন। সুতরাং এই ক্ষেত্রে এবারের বাজেট গতবারের থেকেও চ্যালেঞ্জিং। একই সঙ্গে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে মানুষের জীবনমান উন্নয়নের সঙ্গে দেশের অর্থনীতি উন্নয়নের গতি ধরে রাখা এবং জীবনযাত্রার ওপর ব্যয়ের চাপ কমানো নিঃসন্দেহে আসন্ন বাজেটের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ হবে। কেননা মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার খরচ অনেক বেড়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষকে মুদ্রাস্ফীতির থাবা থেকে মুক্ত করে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আসন্ন বাজেটে মুদ্রাস্ফীতির নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ জোর দেওয়া অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে।

পাশাপাশি আশা করা যাচ্ছে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবারের মতো এবারও একটা বড় চমক থাকতে যাচ্ছে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ভূমিকা অপরিসীম। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে গত ১৫ বছরে সারা দেশে হাজার নতুন রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, সেতু এবং হাইওয়ের নির্মাণ কাজ হওয়ার মাধ্যমে ব্যাপক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। আশা করা হচ্ছে- ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের এই ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে আসন্ন বাজেটে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হতে পারে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট নাগরিকদের নিয়ে একটি ক্ষুধামুক্ত স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ করতে চায়। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কল্যাণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে বাজেটে তাদের জন্য বরাদ্দ আরও বাড়াবে বলে প্রত্যাশা করছি।

আসন্ন বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভাবনার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ বৃদ্ধি, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, সতর্কতার সঙ্গে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি ও এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করবেন বলে আশা করছি। বাংলাদেশের ৫৩তম আসন্ন এই বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হবে তাতে ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে একটি সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী স্মার্ট বাংলাদেশ। তবে এখন আমাদের কাঙ্ক্ষিত সৃজনশীল জ্ঞানভিত্তিক ডিজিটাল অর্থনীতির প্রাথমিক বিকাশ ঘটাতে সুষম এই বাজেটের সুষমও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে ডিজিটাল যুগের উপযোগী মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং উচ্চশিক্ষার পাঠ্যক্রম-পাঠদানসহ পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ডিজিটাল যুগের উপযোগী করতে বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকা ও তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কারণ স্মার্ট সিটিজেন তৈরি করতে হবে আগে। আসন্ন বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রেখে ডিজিটাল দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরি করে বিদেশে পাঠাতে পারলে প্রচুর ফরেন কারেন্সিও পাওয়া যাবে।

উল্লেখ্য, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সাফল্যের ওপর ভর করেই দূরদর্শী, প্রজ্ঞাবান ও বিচক্ষণ নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবসে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে ডিজিটাল বাংলাদেশ ছিল সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘোষণা। ঠিক একইভাবে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণাও ইতোমধ্যে মানুষের মনে শুধু আলোড়ন সৃষ্টিই করেনি বরং সঙ্গে নব আশার সঞ্চার করেছে। স্মার্ট বাংলাদেশ কতটা আধুনিক একটি কর্মসূচি তা এর চার স্তম্ভের লক্ষ্য থেকেই বোঝা যায়। সম্পূর্ণ পরিকল্পনা শর্টটার্ম, মিডটার্ম এবং লংটার্ম টাইমফ্রেমে সাজানো হয়েছে। স্মার্ট সিটিজেন হবেন বুদ্ধিদীপ্ত, দক্ষ, উদ্ভাবনী, সৃজনশীল, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জাগ্রত দেশপ্রেমিক এবং সমস্যা সমাধানে উদ্ভাবনী মানসিকতাসম্পন্ন নাগরিক। প্রত্যেক নাগরিকের প্রযুক্তিতে অভিযোজন ও অভিগম্যতা নিশ্চিত করা হবে। স্মার্ট ইকোনমিতে গড়ে উঠবে ক্যাশলেস, সার্কুলার (বৃত্তাকার), উদ্যোক্তামুখী, গবেষণা ও উদ্ভাবননির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি। আর্থিক লেনদেন হবে নগদবিহীন। পণ্যের পুনঃব্যবহার করে বৃত্তাকার অর্থনীতি গড়ে তোলা হবে। ফলে শূন্য বর্জ্য উৎপাদন হবে। আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই), রোবটিক্স, ব্লকচেইন, ড্রোনসহ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অগ্রসর প্রযুক্তিনির্ভর গবেষণা ও উদ্ভাবনী সমাধান হবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। স্মার্ট গভর্নমেন্ট হবে নাগরিককেন্দ্রিক, স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক। কাগজবিহীন, উপাত্তনির্ভর, আন্তঃসংযুক্ত, আন্তঃচালিত, সমন্বিত, স্বয়ংক্রিয়। যোগাযোগে কাগজের ব্যবহার হবে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে। অগ্রসর প্রযুক্তির ব্যবহার করে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, বিচারব্যবস্থার মতো জরুরি খাতগুলো পরিচালিত হবে অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে। স্মার্ট সোসাইটি নিশ্চিত করবে বৈষম্যমুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়ভিত্তিক এক সমাজব্যবস্থা। সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ সহনশীল সমাজ, যা হবে নিরাপদ ও টেকসই। আর্থিকসহ সব ধরনের সেবায় নাগরিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলা হবে। এ সবকিছুর মূল চালিকাশক্তি হবে বাংলাদেশের এই আসন্ন বাজেট। এই বাজেট যত স্মার্টলি ডিজাইন করা হবে, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ ততই ত্বরান্বিত হবে। ফলে অচিরেই বাস্তবায়িত হবে আমাদের স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা।

লেখক:উপাচার্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয়:

ট্রিলিয়নিয়ার এবং বৈষম্যের হট চেয়ার

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সুধীর সাহা

অষ্টাদশ-উনবিংশ শতকের জন জেকব অ্যাস্টর পশম, ভূসম্পত্তি এবং আফিম পাচারকারী এক জার্মান-আমেরিকান ব্যবসায়ী হয়েছিলেন আমেরিকার প্রথম মিলিয়নিয়ার বা দশ লাখ ডলারের মালিক। এক শতাব্দী পর ১৯১৬ সালে পৃথিবীর প্রথম বিলিয়নিয়ার অর্থাৎ ১০০ কোটি ডলারের মালিক হয়েছিলেন আমেরিকার জন ডি রকফেলার। এরও ৮৩ বছর পর আমেরিকার বিল গেটস মালিক হন ১০০ বিলিয়ন ডলারের। ২০২৩ সালের ফোবর্সের তালিকায় পৃথিবীতে মোট বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৬৪০ জন। ২০২৪ সালে এসে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ৭৮১ জনে। এখন বিলিয়নিয়ারদের মধ্যে লড়াই হচ্ছে- কে হবেন আগামী পৃথিবীর প্রথম ট্রিলিয়নিয়ার। ১-এর পিঠে মোট ১২টা শূন্য বসাতে হয় এক ট্রিলিয়ন অর্থাৎ এক লাখ কোটি ডলার লিখতে। কে হবেন ট্রিলিয়নিয়ার- হট সিটে বসবেন কোন ট্রিলিয়নিয়ার আগামীর গেম শোতে? শুরু হয়ে গিয়েছে প্রতিযোগিতার গেম শো। এখন শুধু অপেক্ষার পালা- এ গ্রহের প্রথম লাখো কোটিপতি দেখার।

পৃথিবীর মাত্র ১৯টা দেশের জিডিপি এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। অর্থাৎ বাকি সব দেশের জিডিপি এক ট্রিলিয়ন ডলারের নিচে। ভাবতে পারেন, তা কত টাকা? হাজার ডলারের নোটের পাঁজা সাজিয়ে দিলে এক ট্রিলিয়ন থেকে ৬৭ মাইল উঁচু হবে সেই পাঁজা। কে হবেন সেই ভাগ্যবান। পৃথিবীর প্রথম ট্রিলিয়নিয়ার অর্থাৎ লাখো কোটিপতি? সাম্প্রতিককালের অতি ধনীদের অনেকেই অমিত সম্পদশালী হয়েছেন জ্ঞান, ধারণা, অনুমান, ঝুঁকি এবং বিনিয়োগকে সম্বল করে। ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সৃজনশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব এবং এআই-এর বিজয়কেতন। গোড়ায় অনেকেরই ধারণা ছিল, পৃথিবীর প্রথম ট্রিলিয়নিয়ার হবেন বিল গেটস। পরবর্তীতে সেই জায়গা করে নিলেন অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস। তারপর আসরে প্রবলভাবে অবতীর্ণ হন টেসলার সিইও ইলন মাস্ক। ২০১৯ সাল থেকে ইলন মাস্কের নিজস্ব সম্পদ বেড়েছে গড়ে বছরে ১৬২ ভাগ। ট্রিলিয়নিয়ার কে হবেন- এ নিয়ে গবেষণা চলছে এবং কেউ কেউ ভবিষ্যদ্বাণীও করে রেখেছেন। ২০১৭ সালে আমেরিকান বিলিয়নিয়ার মার্ক কিউবান ভবিষ্যদ্বাণী করেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করা কোনো উদ্যোগপতিই হবেন দুনিয়ার প্রথম ট্রিলিয়নিয়ার। ২০২১ সালে মর্গান স্ট্যানলির বিশ্লেষকরা বলেছিলেন, ইতিহাসের প্রথম ট্রিলিয়নিয়ার হতে চলেছেন ইলন মাস্ক। ‘ট্রিপল টি অ্যাপ্রুভ’ নামক সংস্থার ২০২২-এর এক সমীক্ষায় বলা হয়, দুনিয়ার যে ২১ জনের ট্রিলিয়নিয়ার ক্লাবের সদস্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের মধ্যে অগ্রণী হলেন ইলন মাস্ক। তাদের সমীক্ষা অনুযায়ী, সম্ভাব্য তালিকার এই ২১ জনের মধ্যে আমাদের পাশের দেশ ভারতের গৌতম আদানি, মুকেশ আম্বানি এবং চীনের ঝ্যাং ইয়িমিংয়ের নামও বিদ্যমান। অক্সফামের সাম্প্রতিক একটি রিপোর্ট অনুমান করেছে, অতি ধনীদের আলিবাবার রত্নগুহা ফুলে-ফেঁপে ওঠার হার যদি এভাবে অক্ষুণ্ন থাকে, তবে এক দশকের মধ্যেই তৈরি হবে পৃথিবীর আগামী ট্রিলিয়নিয়ার।

ধনীদের এহেন গল্পের হাত ধরেই দুনিয়ার অসাম্য বাড়ছে। ধনীদের গেম শোতে খেলতে থাকা এই খেলোয়ারদের নিশ্চিতভাবে রয়েছে কয়েকখানা ‘লাইফলাইন’Ñ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অতিমারি, যুদ্ধÑযা অতি ধনীদের সঙ্গে বাকিদের ফারাক বাড়াতেই থাকছে। আমাদের পাশের দেশ ভারতের অসাম্যের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে অর্থনীতিবিদ তোমা পিকেটি এবং তার সহগবেষক নীতিন ভারতী, লুকাস চ্যান্সেল এবং আনমোল সোমাঞ্চির সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র থেকে। তারা দেখিয়েছেন, ২০২২-২৩ সালে আয়ের নিরিখে জনসংখ্যার ধনীতম এক শতাংশ মোট আয়ের ২৩% অর্জন করেছেন। বিত্তের হিসাবে ধনীতম এক শতাংশ দেশের মোট সম্পদের ৪০%-এর মালিক। চিত্রটি শুধু ভারতের একার নয়। একই চিত্র দেখা যাবে পৃথিবীর অন্য দেশেরও; এমনকি বাংলাদেশের জন্যও চিত্রটি একই হবে। গবেষণার অভাবে এমন চিত্র প্রকাশ না হলেও প্রকৃত অর্থে অসাম্যের মাত্রা বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে সর্বাধিক। অসাম্যের বিতর্কে সাধারণভাবে তিন ধারাকে চিহ্নিত করা হয়- নীতিগত, চরিত্রগত এবং ব্যবহারিক কৌশলগত। অসাম্য কি রাষ্ট্র মেনে নেবে- অবাঞ্চিত করবে, না আংশিকভাবে সহনীয় করে তুলবে? এটিই নীতিগত বড় প্রশ্ন রাষ্ট্রের সামনে। এরপর প্রশ্ন উঠতে পারে অসাম্যের চরিত্র নিয়ে। অসাম্য কি সুযোগের, না ফলাফলের? প্রশ্ন থাকে, রাজনৈতিকভাবে যারা সুযোগ পাচ্ছেন, তারাই কি সবচেয়ে যোগ্য, সবচেয়ে দক্ষ, সবচেয়ে প্রতিভাবান? দারিদ্র্যের কারণে কি কারও মেধা বিকাশের পথ বন্ধ হয়ে যায়? অথবা গুণহীন কেউ বিত্তবান হওয়ার কারণে কোনো পেশা বা ক্ষমতাশীল আসনের সর্বোচ্চ স্তরে উঠে যায়? যদি মেনেও নিই, খানিকটা অসাম্য অনিবার্য অথবা অসাম্যের সমস্যাটি গুরুত্বপূর্ণ, তাহলেও এ নিয়ে কী করা যায় সেটাই ব্যবহারিক কৌশলের প্রশ্ন। তবে এ নিয়ে বিতর্ক থেকেই যায়। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্য হ্রাসের সম্পর্ক অস্বীকার করার উপায় নেই। অন্যদিকে, এর ফলে অসাম্যের প্রসারও বৃদ্ধি পায়। কেননা, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ফলে অর্থনৈতিক সুযোগের যে প্রসার হয়, তার সদ্ব্যবহার করার ক্ষমতা বিত্তবান শ্রেণির বেশি। তাই বৃদ্ধির হাত ধরে অসাম্যও ঘরে ঢুকে বসে। সেখানেই প্রশ্ন থাকবে বৃদ্ধির প্রক্রিয়ার ওপর। বৃদ্ধির প্রক্রিয়া যদি সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে (যাকে চিহ্নিত করা যায় সর্বজনীন বৃদ্ধি হিসাবে), তাহলে অসাম্যের ধারাল ছুরির আঘাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।

ধনীরা সব দেশেই রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এবং নানাভাবে সরকারি নীতির ওপর নিজেদের সুবিধার্থে প্রত্যক্ষ প্রভাব বিস্তার করেন। ধনীদের অস্বীকার করা কিংবা উপেক্ষা করা কোনো দেশের সরকারেরই সম্ভব হয়ে ওঠে না, তা সে আমেরিকাই হোক কিংবা বাংলাদেশই হোক।

লেখক: কলামস্টি


বাজেট যখন জীবন ও জীবিকার

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

সবাই উদ্গ্রীব এখন জাতীয় বাজেটের জন্য। প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে জীবন ও জীবিকার বাজেট জাতীয় বাজেটের থেকে আলাদা কিছু কি না। এ প্রশ্ন ওঠাও স্বাভাবিক যে জাতীয় বাজেটের মধ্যে করোনা মোকাবিলার মতো, অর্থনীতি গণস্বাস্থ্য জন-শিক্ষা পুনরুদ্ধারের মতো জরুরি বিষয়গুলো প্রাধান্য পাচ্ছে কি না, প্রশ্ন এ কারণেও উঠতে পারে যে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ প্রকৃতপ্রস্তাবে প্রয়োজনীয় খাতে (এ মুহূর্তে যেমন জীবন ও জীবিকা) যথাযথ (ব্যয় সাশ্রয়ী, অর্থায়ন আয় বৃদ্ধি ও কৃচ্ছ্রসাধন অর্থে ব্যয় সংকোচন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, সরকারি-বেসরকারি খাত দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে দুর্যোগ মোকাবিলায়) ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, নতুন বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য সবাই পরামর্শ দেন, সুপারিশ করেন দাবি তোলেন; কিন্তু সেই বরাদ্দের বিপরীতে অর্থায়ন ও লক্ষ্যভেদি বাস্তবায়নের পরিস্থিতি, সেই ব্যয়ের তাৎক্ষণিক, স্বল্প মধ্য দীর্ঘমেয়াদি ইমপ্যাক্ট ও অভিঘাত সম্পর্কে অবহিত হওয়ার অবকাশ বরাবরই হালে পানি পায় না। সাধারণ সময়ে সেই অবকাশ কমবেশি দেরিতে মিললেও করোনা মোকাবিলার মতো জরুরি সময়ে বরাদ্দ ব্যবহার এবং কর্মপরিকল্পনা প্রয়োগও জরুরি এ কারণে যে ‘রোগী মারা যাবার পর চিকিৎসকের উপস্থিতির’ মতো পরিস্থিতির যেন উদ্ভব না হয়।

জীবন ও জীবিকার জন্য বাজেটকে জাতীয় বাজেট থেকে আলাদা অলিন্দে নয়, একীভূত হিসেবে দেখাই জরুরি। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষি খাতে অগ্রাধিকার ঘোষণা এবং বরাদ্দ বাড়ালেই বাজেট জনগণের বাজেট বা ইতিবাচক হয় না, স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ালেই মহামারি মোকাবিলা রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা অটোমেটিক্যালি বাড়ে না, যদি এই খাতের ব্যয়ের সক্ষমতা ও সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন বহাল থাকে, দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা-অপারগতায় আকীর্ণ থাকে এবং তা নিরসন নিয়ন্ত্রণে তথা জবাবদিহিকরণে ‘কথায় নয় কাজে’ অগ্রগতি না থাকে। বাজেটে বরাদ্দ বড় কথা নয়, অর্থনীতিতে সেই বরাদ্দের দ্বারা কতটা সম্পদ ও সেবা সৃষ্টি হলো, প্রভাব ফেলতে পারল সেটিই বড় কথা ।

করোনা সংকটে বেশি মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের কর্মসংস্থান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার মতো খাতগুলোকে অগ্রাধিকার প্রাপ্য। গত বছর (এখনো পর্যন্ত চলতি বাজেটবর্ষে) করোনা ও বৈশ্বিক টালমাটাল পরিস্থিতির প্রভাবে বাজেট প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতের গুরুত্ব আলোচিত হলেও, সেখানে বরাদ্দ নমিনাল টার্মে আপেক্ষিকভাবে কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও দেখা যায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শিক্ষা, দক্ষ জনসম্পদ তৈরি, ফর্মাল ও ইনফর্মাল সেক্টরে কর্মসৃজনমূলক শিল্পোদ্যোগে কার্যকর পদক্ষেপের, বাস্তবায়নের খাতে বরাদ্দ সে হারে আরও বাড়ানো প্রয়োজন ছিল, যেভাবে বা হারে অন্য অনেক অগৌণ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছিল সেভাবে বা হারে করোনা যে আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি সাধন করেছে তা পুনরুদ্ধারে পরিপূরক ও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারত সেসব খাত যেমন- স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসংস্থান, সামাজিক সুরক্ষা খাতে বাড়েনি। তথাপি এবং তদুপরি সেই বরাদ্দকৃত অর্থের বণ্টন ও ব্যবহার বা বাস্তবায়নের হিসাব মেলানোর সুযোগ সীমিত। করোনাকালে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ শিক্ষাকার্যক্রমবিহীন (বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে) খাতে ব্যবহৃত হয়েছে। বিদ্যমান ডিজিটাল প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে মহানগর ও শহরে বিকল্প (অনলাইনভিত্তিক) শিক্ষা কার্যক্রম কিছুটা চললেও, ব্যাপক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের পাঠবিমুখ করা হয়েছে। টেবিল-চেয়ার পাহারা আর দায়-দায়িত্ব কর্মহীন শিক্ষকের পিছনে এবং বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণে ব্যবহৃত হয়েছে সিংহভাগ বরাদ্দ। অগৌণে শিক্ষা খাতের দিকে দৃষ্টি না দিলে শিক্ষায় বা সমাজে যে ক্ষরণ ও ক্ষত সৃষ্টি হবে তা হবে করোনার সেরা অভিঘাত। জাতীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন ক্ষেত্রে এ ধরনের বৈষম্য যত বাড়বে তত জাতীয় উন্নয়ন প্রয়াস মাঠে মারা যাবে। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা কিংবা বিকল্প শিক্ষা কার্যক্রম স্থানীয়ভাবেই সাময়িকভাবে হলেও চালু রাখার যৌক্তিকতাকে মাথায় নিতে হবে। ‘অটো’ পাশের মতো আত্মঘাতী পদক্ষেপে যাওয়া থেকে দূরে থাকা হবে জাতীয় কাণ্ডজ্ঞানে দায়িত্বশীলতার পরিচয়। জীবন-জীবিকার বাজেটে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখার বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ অর্থনীতির প্রাণ বায়ু কৃষি খাতে কৃষির উৎপাদন কৃষি তথা সামগ্রিকভাবে কৃষি খাতের উন্নতি একটি সম্মিলিত প্রয়াস। যেখানে কৃষিবিদ, কৃষিবিজ্ঞানী, কৃষক ও কৃষি উপকরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রাইভেট সেক্টর, আমিষ, শর্করা সরবরাহকারীরাও সরাসরি জড়িত। কৃষিক্ষেত্রে ভর্তুকি/প্রণোদনা যেন যথাযথভাবে এবং যথাসময়ে সত্যিকার প্রান্তিক চাষিরা, খামারিরা পান। নতুন নতুন উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে বাংলাদেশে প্রাইভেট সেক্টরের অবদান কম নয়। সে জন্য পাবলিক সেক্টরের পাশাপাশি প্রাইভেট সেক্টরেও বাজেট বরাদ্দ থাকা উচিত। রাসায়নিক সারের তুলনায় জৈবসারে মাটির স্বাস্থ্য ভালো করে বিধায় রাসায়নিক সারের মতো বাজেটে জৈবসার উৎপাদনে ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। প্রান্তিক চাষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তা,খামারি, মাছ চাষির কাছে স্টিমুলাস প্যাকেজের টাকা পৌঁছায়নি। ব্যাংক বা আর্থিক খাতে বিশাল ব্যাধির সুচিকিৎসার ব্যবস্থা হয়নি। ধনী আরও ধনী হওয়ার সহজ সুযোগে আয়-বৈষম্য বেড়েই চলেছে। অন্তর্ভুক্তির নামে বিচ্ছিন্নতাই বাড়তে থাকলে ‘কাউকে পেছনে ফেলা যাবেনা’ এস ডিজি গোল অর্জনের এ মর্মবাণী সকরুণ ব্যর্থতার বিবরে উন্নয়নশীল অর্থনীতির কপোলে কালো তিলক আঁকতেই থাকবে।

এই মুহূর্তে করোনা মোকাবিলায় দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে চলমান ও টেকসই রাখতে সুপরিকল্পিত ও সম্প্রসারণধর্মী বাজেটের কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার, বাজেট বাস্তবায়নে যথাযথ পরিবীক্ষণ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ধর্মী যোগাযোগ ও লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সমঝোতা বৃদ্ধি, ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সবার সঙ্গে একজোট হয়ে কাজ করতে পারলে করোনাকালেও দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বৈকি। করোনাকাল সহসা চলে যাবে এমন ধারণায় চলতি বাজেট করা হয়েছিল, করোনা এখনো যায়নি, জীবন ও জীবিকার সন্ধানে ঝুঁকি নিয়ে মানুষ দ্বিতীয় ধাক্কা আসার আগে নিজের থেকে ছোটাছুটি করছে এটাকে স্বস্তির ও আত্মতৃপ্তির বিষয় ভাবা সমীচীন হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। ২০২১ সালেও করোনার অভিঘাত অব্যাহত থাকবে এটা মনে রেখে বাজেটে পরিকল্পনা আটতে হবে। ব্যয় কৃচ্ছ্রসাধনে ঢিলেমি কিংবা যেকোনো প্রসঙ্গ পলায়নি মনোভাব, দোষারোপ হবে অবিবেচকের কাজ।

এখন জ্বলন্ত ইস্যু হচ্ছে করোনাভাইরাস। জীবন বাঁচানোর প্রশ্ন প্রথম, দ্বিতীয় ইস্যু হচ্ছে জীবিকা। তৃতীয় এবং অন্যতম ইস্যু সর্বস্তরে পরিব্যাপ্ত দুর্নীতি দমন। অভ্যন্তরীণ বাজার ও ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো। এটা এখন এক নতুন বাংলাদেশ। আগের অবস্থা আর ফিরে আসবে না। নতুন পরিস্থিতি, নতুন সমস্যা, নতুন সম্ভাবনা। অর্থনীতির কাঠামো পরিবর্তনে এগিয়ে আসতে হবে। মোদ্দা কথা, অর্থনীতিতে রেজিলিয়েন্ট পাওয়ার এবং মানবদেহে ইমিউন পাওয়ার বাড়াতে হবে। সামনের চ্যালেঞ্জগুলো যেমন- ব্যয়ের বাজেটে অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ (রাজস্ব আয়) সম্পদের অপ্রতুলতা, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে দৃশ্যত স্থবিরতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অনুপস্থিতির আড়ালে, দুর্নীতিগ্রস্ততায় অর্থনীতিতে ক্ষরণ, কস্ট অব ডুয়িং বিজিনেসের ঊর্ধ্বগামিতা, মেগা প্রকল্পে ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়ার পরিবর্তে ব্যয় বৃদ্ধি, প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘ সূত্রতা, করোনাকালে কিংবা করোনা-উত্তর অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় কৃচ্ছ্রসাধন ও ব্যয় সংকোচনের দারি ও যৌক্তিকতা অনুসরণে অপারগ পরিস্থিতি ও পরিবেশ, বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া, প্রবাসীদের দেশে ফেরা, রপ্তানি বাজার সংকুচিত হওয়া, জলবায়ুর পরিবর্তন হেতু বন্যা, ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ে কৃষি উৎপাদন ও জানমালের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বহির্মুখীন খাত ও ক্ষেত্রগুলো সংকুচিত হওয়া।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা আপাতত রাজস্ব আহরণ খাতে চলমান সংস্কার ও অনলাইনিকরণ বাস্তবায়নে দৃঢ়চিত্ত ও সময়সূচিভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করা। বিদ্যমান আইনের সংস্কার এবং অনলাইনিকরণ ব্যতিরেকে বিদ্যমান কর্মকাঠামো ও লোকবল দিয়ে রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতি ও পরিবেশের উন্নয়ন সাধন সম্ভব ও সমীচীন হবে না। করদাতা এবং কর আহরণকারী দপ্তরের মধ্যে রাজস্ব আহরণবিষয়ক জটিলতা সমস্যা আপিল আবেদন নিষ্পত্তি উপরিদর্শনের মাধ্যমে পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কর ন্যায়পাল অফিস পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা; বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অচল অর্থনীতিকে সচল রাখার, বেকার ও ক্ষুধা রোখার, করোনায় ক্ষতি পুনরুদ্ধার ও পুনর্বাসন, করোনা ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি সৃষ্ট মন্দা মোকাবিলা এবং সম্ভাব্য সুযোগের (কৃষি, স্বাস্থ্যখাত, আইটি, দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার খাতে অধিক মনোযোগ ও দক্ষ জনবল সৃষ্টিসহ বিদেশফেরত বিদেশি বিনিয়োগ ঘরে আনা) সদ্ব্যবহার ও অনিশ্চিত পরিস্থিতি মোকাবিলার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ, কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন দিক-নির্দেশনা ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে বাজেটে আয়-ব্যয় বণ্টনে, কৌশল নির্ধারণে তার প্রতিফলন থাকতে হবে।

লেখক: সরকারের সাবেক সচিব, এন বি আরের সাবেক চেয়ারম্যান

বিষয়:

মূল্যস্ফীতির চাপে অর্থব্যবস্থার গতিভঙ্গ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রজত রায়

রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের পর সারা বিশ্বে যখন মূল্যস্ফীতি বাড়ছিল, তখন প্রায় সব কেন্দ্রীয় ব্যাংকই সুদহার বৃদ্ধির মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। এতে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই সফল হয়। তবে বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির দেখা মিললেও বাংলাদেশ ব্যাংক তখন কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। প্রায় সব দেশ যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফলতা পেতে শুরু করে, তখনো বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষায় আমদানি সীমিত করে আনে। এতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দীর্ঘ সময় ধরে বহাল রয়েছে।

মূল্যস্ফীতি হলো দামের ধারাবাহিক বৃদ্ধি। কোনো একটি বা দুটি পণ্যের নয়, একজন গড় ক্রেতার প্রয়োজন, এমন সব পণ্যের সম্মিলিত ‘বাস্কেট’-এর দামের বৃদ্ধি। মূল্যস্ফীতি সমস্যা তৈরি করে। মূল্যস্ফীতির ফলে প্রতিদিনের কেনাকাটার খরচ বাড়ে। সাধারণত বাজারে মূল্যস্ফীতি ঘটলে চাকরিদাতা সংস্থা কর্মীদের বেতন বাড়ায়, যাতে এই বাড়তি দামের কারণে বেড়ে যাওয়া খরচ সামলানো যায়; কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বেতন যতটুকু আর যতটুকু বাড়ল, তা মূল্যস্ফীতির বোঝা সামলানোর জন্য যথেষ্ট নয়। অনেকের ক্ষেত্রে তো বেতন আদৌ বাড়ে না- দুর্ভাগ্যক্রমে, দরিদ্রতম শ্রমিকরাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই দলে থাকেন। ফলে মূল্যস্ফীতি হলে গরিব মানুষের পক্ষে খাবারের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনাও কঠিনতর হয়। অন্য ভাষায় বললে, মূল্যস্ফীতি নীরবে গরিব মানুষের টাকা লুট করে। তাই মূল্যস্ফীতিকে প্রায়ই একটি কর হিসাবে দেখা হয়।

মূল্যস্ফীতির ফলে কি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিপাকে পড়ে? হ্যাঁ, মূল্যস্ফীতির ফলে ব্যবসাও সমস্যায় পড়ে। ধরা যাক, খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ঘটল কাজেই, খাবার কিনতে হলে একটা মাঝারি আর্থিক সামর্থ্যসম্পন্ন পরিবারকে অন্য কোনো খাতে খরচ কমাতে হবে। আবার বেশি অপরিহার্য নয়, এমন জিনিস কেনাকাটায় কাঁটছাট করতে হয়। যেমন- প্রসাধনী সামগ্রীগুলো শ্যাম্পু বা সাবান ফলে, এজাতীয় কোম্পানিগুলো বিপাকে পড়ে। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতি হারায়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তথ্য মোতাবেক, এপ্রিল-২০২৪ গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ বলতে বোঝায় ২০২৩ সালের এপ্রিলে যে পণ্য ১০০ টাকায় কেনা সম্ভব হয়েছিল ২০২৪ সালের এপ্রিলে তা কিনতে হয়েছে ১০৯ টাকা ৭৪ পয়সায়।

সূত্র মতে, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। তবে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার সরকারের যে লক্ষ্যমাত্রা তার ধারে-কাছেও রাখা সম্ভব হচ্ছে না। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। গত এপ্রিল মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০ দশমিক ২২ শতাংশ উঠেছে। তবে মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষ বেশি চাপে আছে। একই সঙ্গে যে হারে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে সেভাবে মানুষের আয় বাড়েনি। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে অনেক দেশে মূল্যস্ফীতি ঘটে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক ও মূল্য হ্রাসের কারণে অনেক দেশে পর্যায়ক্রমে নেমে আসে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি উল্টো আরও বাড়তে থাকে।

আমাদের মূল্যস্ফীতি তা হলে কিসের ওপর নির্ভর করে? আমাদের মূল্যস্ফীতি নির্ভর করে আংশিক আন্তর্জাতিক মূল্যও আংশিক অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপর। গত দুই বছরে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য বেড়েছে, ওই সময় দেশেও বেড়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক কমলেও আমাদের মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলছে। ফলে বিশ্ববাজারে দাম কমলেই দেশে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মূল্যস্ফীতি কমবে সেটি ধরে নেওয়া যায় না। এখন আমরা কতটা পণ্য আমদানি করতে পারছি, ডলারের মজুত কেমন, ঘাটতি বাজেটের জন্য কতটা টাকা প্রয়োজন, মুদ্রানীতি সংকোচন না সম্প্রসারণ দেওয়া হচ্ছে রাজস্বনীতি এসবের ওপর নির্ভর করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ।

মূল্যস্ফীতির ফলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা কঠিনতর হয়। এটা শুধু যে গৃহস্থালির ক্ষেত্রে সত্যি তা নয়, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও সত্যি। ধরা যাক, কোনো পরিবার তাদের মাসিক আয় থেকে পরিকল্পনামাফিক টাকা জমাচ্ছেন, যাতে চাকরি অবসরের পর সংসার চালানোর জন্য হাতে যথেষ্ট টাকা থাকে। যেকোনো পরিবার এ ধরনের সঞ্চয় করে থাকতে পারে এবং তারা এটাও বোঝেন, আজ সংসার চালাতে যে পরিমাণ টাকা খরচ হচ্ছে ১০ বা ১৫ বছর পর জীবনযাত্রার চলমান মান বজায় রাখতে হলে অনেক বেশি টাকার প্রয়োজন হবে। ফলে তারা মূল্যস্ফীতির একটি নির্দিষ্ট হার ধরে নিয়েই টাকা জমানোর পরিকল্পনা করেন; কিন্তু খুব বেশি হারে মূল্যস্ফীতি ঘটতে থাকলে হিসাব গুলিয়ে যায়। ফলে অবসর গ্রহণের সময় তিনি যদি একটি বাড়ি বা গাড়ি কেনার কথা ভাবেন তখন এই অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতির ফলে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। ঠিক তেমনিভাবে কোনো সংস্থা যদি আজ একটি কারখানা বা বিমানবন্দর তৈরি করার কথা ভাবে তাহলে তাদের হিসাব করতে হয়, আগামী এক-দুই দশকে সেই বিনিয়োগ থেকে কী রকম টাকা আয় করা যেতে পারে এবং কত খরচ হতে পারে। মূল্যস্ফীতির হার যদি স্থিতিশীল না হয়, তবে সেই হিসাব করা মুশকিল হবে। যদি চড়া হারে বা এলোপাতাড়ি মূল্যস্ফীতি ঘটতে থাকে, তবে কোনো সংস্থার পক্ষে এই হিসাব করা কঠিন হবে। ফলে তারা সাবধান হয়ে বিনিয়োগ থেকে হাত গুটিয়ে নিতে পারে। তেমনটা হলে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির ক্ষতি হয়।

গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) তথ্য মোতাবেক, বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হারে নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়ায় তা বাড়ছে। এটা মূল্যস্ফীতি কমাতে ভূমিকা রাখবে, তবে তা সময় সাপেক্ষ। একদিকে সুদের হার যদি বাড়ে, আরেক দিকে মার্কিন ডলারের দামও বাড়তে থাকে, তাহলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে না। কারণ ডলারের দাম বাড়লে পণ্য ও কাঁচামালের আমদানি ব্যয় বাড়ে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভোক্তার চাহিদা হ্রাসের লক্ষ্যে নীতিসুদহার বাড়ানো ও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হয়েছে। সুদের হার ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৯ শতাংশ সুদহারের ক্যাপ তুলে নেওয়া হয়েছে। এ উদ্যোগের ফলে ব্যাংকের তারল্য আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে। ফলে বাজারে ভোক্তার চাহিদা হ্রাস পাবে এবং মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক হবে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির আওতায় সরকারের উন্নয়ন খাতে ঋণ বন্ধ রেখেছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ব্যয় মেটাতে রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করছে। মূল্যস্ফীতির আশঙ্কার অন্য কারণ হলো আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের চড়া দাম। চীনের নির্মাণ ক্ষেত্র ফের চাঙ্গা হয়েছে এবং এর ফলে অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ৯০ ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। পশ্চিম এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক সংকটের ফলে তা আরও বাড়ার আশঙ্কা।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ শুধু সুদহার বাড়ানোই নয়, নিত্যপণ্যের বাজারে অব্যাহত নজরদারি রাখা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ। দক্ষিণ এশিয়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যুগান্তকারী উদাহরণ তৈরি করেছিল শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাদের মূল্যস্ফীতি যখন ৮০ শতাংশের কাছাকাছি ছিল, তখন সুদহার বাড়িয়েই বসে থাকেনি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। খুচরা বাজার থেকে শুরু করে পাইকারি বাজারের প্রত্যেকটি পণ্যে নজরদারি করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। প্রতিদিনের পণ্যমূল্যের তথ্য শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রদর্শন করা হতো।

মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯-২০২১ সাল পর্যন্ত দেশে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ; কিন্তু চলতি বছরে প্রতি মাসে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে বিরাজ করছে। কোভিড মহামারির পর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় অস্থিরতা দেখা দেয়। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকলে এর প্রভাব এসে পড়ে বাংলাদেশের ওপর। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অর্থনৈতিক কারণগুলো রাজস্ব ও মুদ্রানীতির মাধ্যমে মোকাবিলা করতে হবে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সতর্ক থাকতে হবে।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক


বাংলাদেশে রোহিঙ্গা পুনঃআশ্রয়ের আহ্বান: গোদের ওপর বিষফোড়া

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. রাশিদ আসকারী

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ের বৃহত্তম এবং দীর্ঘস্থায়ী মানবিক সংকটগুলোর একটির মুখোমুখি হয়ে নজিরবিহীন উদারতা প্রদর্শন করেছে। ২০১৭ সাল থেকে এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলমানকে আশ্রয় দিয়েছে দেশটি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘মানবতার জননী’ অভিধায় অভিষিক্ত হয়েছেন। তবে বর্তমানে নানামাত্রিক কারণে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দ্রুত দুঃসহ হয়ে উঠছে। তাই, বাংলাদেশের ওপর আরও রোহিঙ্গা গ্রহণ করার আন্তর্জাতিক আহ্বান পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় সম্পূর্ণ অবাস্তব এবং অযৌক্তিকও বটে। বাস্তবতা হলো, সাম্প্রতিক সময়ে ৪৫,০০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের সীমান্তে নাফ নদীর কাছে একটি এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। প্রাণ রক্ষার্থে তারা মানবিক সুরক্ষা খুঁজছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দেশকে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তাদের কার্যকর সুরক্ষা প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন। প্রকারান্তরে বাংলাদেশকে আশ্রয়প্রত্যাশী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন। এ ছাড়াও জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের মুখপাত্র লিজ থ্রোসেল সম্প্রতি বাংলাদেশকে মিয়ানমারের বর্তমান সংঘাতের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন না করার আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের অবস্থান থেকে হয়তো তারা ঠিকই বলেছেন। তবে, বাংলাদেশের নিজস্ব অবস্থান থেকে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াও তাদের বিবেচনায় আনা জরুরি। বিদ্যমান সামাজিক-অর্থনৈতিক চাপ, নিরাপত্তা হুমকি এবং বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য সমস্যাগুলো বিবেচনা করে নতুন রোহিঙ্গাদের গ্রহণ না করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত ‘অ্যান্টি-ইমপোর্টেশন’ (আর রোহিঙ্গা না আনা) মনোভাব সম্পূর্ণ সমর্থনযোগ্য ।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দশকব্যাপী চলমান পদ্ধতিগত নির্যাতনের কারণে সহিংসতার স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে সংকট চরম পর্যায়ে পৌঁছায় যখন সামরিক বাহিনী হাজার হাজার রোহিঙ্গার ওপর নির্মম পীড়ন অভিযান শুরু করে। প্রাণ বাঁচাতে তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসে। এবং বাংলাদেশ মানবিক কারণে দ্রুততার সঙ্গে সহৃদয় সাড়া দেয়। যদিও বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার সীমান্ত খুলে দেয় এবং শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় শহর কক্সবাজারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির তৈরি হয়।

মিয়ানমার থেকে আসা বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই মারাত্মক চাপে রয়েছে। রোহিঙ্গারা অপুষ্টি থেকে শুরু করে কলেরা এবং ডিপথেরিয়া পর্যন্ত নানা রোগে ভুগছে এবং স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবাগুলো শরণার্থীদের তাৎক্ষণিক ও স্থায়ী চিকিৎসা প্রদানে হিমশিম খাচ্ছে। রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষাও একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা আনুষ্ঠানিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং মূলধারার সমাজে একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে। রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতির যে স্রোত প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষ্য করা গিয়েছিল, সংগত কারণেই তা ফিকে হয়ে আসছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে সৃষ্টি হওয়া আশার আলো ইতোমধ্যেই হতাশায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে তাদের দীর্ঘ অবস্থান এলাকায় নিরাপত্তা-হুমকি সৃষ্টি করছে, কারণ রোহিঙ্গারা গোঁড়াপন্থি মৌলবাদী হয়ে উঠছে এবং বিভিন্ন আন্তসীমান্ত অপরাধকর্মে লিপ্ত হচ্ছে, যা সামগ্রিক পরিস্থিতিকে জটিলতর করে তুলছে।

এই প্রেক্ষাপটটি মাথায় রাখা অতীব গুরুত্বপূর্ণ; বিশেষ করে যখন নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেওয়ার আহ্বান বিবেচনা করা হয়। এটা হবে গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো অসনীয়। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই অবিশ্বাস্য উদারতা এবং অনুকম্পা প্রদর্শন করেছে। এবং তার জন্যে চড়া মূল্য পরিশোধ করে চলেছে। এমতাবস্থায় আবারও রোহিঙ্গা গ্রহণের আহ্বান কেবল অন্যায়ই নয়, বরং সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং উদ্ভট এক মামাবাড়ির আবদার। এটা কোনো নীতি হতে পারে না যে, একমাত্র বাংলাদেশকেই রোহিঙ্গাদের একমাত্র ধারক ও বাহক হয়ে থাকতে হবে অনন্তকাল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং স্বাগতিক দেশ উভয়ের তাৎক্ষণিক প্রয়োজনের বাইরে দীর্ঘমেয়াদি পর্যাপ্ত সহায়তা প্রদান করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক মানবিক বোঝা ভাগাভাগির নীতির ওপর ভিত্তি করে অনেক বৈশ্বিক সংস্থা গড়ে উঠেছে। কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ শরণার্থী যথেষ্ট আর্থিক সহায়তা পায়নি, যাতে তারা দেশে ফিরে যেতে পারে বা ধনী দেশগুলোতে পুনর্বাসিত হতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে আরও বেশি এবং স্থায়ী সহায়তা প্রদান করে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে হবে।

বর্তমানে বিদ্যমান শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় আর্থিক সাহায্য বাড়ানো অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান তহবিল শরণার্থী এবং স্বাগতিক দেশের প্রয়োজন মেটাতে একেবারেই অপ্রতুল। রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের সুযোগ প্রদানকারী দেশের সংখ্যা বাড়ানো উচিত। এ ধরনের স্থানান্তর পদক্ষেপ বাংলাদেশের শরণার্থীর ভার কিছুটা লাঘব করতে পারে এবং রোহিঙ্গাদের বৈষম্যহীনভাবে বাঁচার নতুন আশা জাগাতে পারে। এর জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের মধ্যেও সদিচ্ছা এবং সংহতির প্রয়োজন- যা এখন পর্যন্ত দুঃখজনকভাবে অনুপস্থিত। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ এবং স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে মিয়ানমারের ওপর শক্তিশালী বৈশ্বিক কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে। সে জন্য নাগরিকত্বের অধিকার সুরক্ষিত করা, সহিংসতা থেকে নিরাপত্তা এবং জীবিকাসহ প্রয়োজনীয় সেবাগুলোতে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

যদিও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল বেশ আগেই। কিন্তু তাদের অধিকার এবং নিরাপত্তার বিষয়ে প্রয়োজনীয় আশ্বাসের অভাবে তা থমকে দাঁড়িয়েছে। তা পুনরায় সচল করতে বাংলাদেশকে অবশ্যই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বেগবান ও অর্থবহ করতে হবে, যাতে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের অনুকূল শর্ত তৈরি করার জন্য বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়গুলোকে স্বপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে এবং নৈতিক বাধ্যবাধকতা থেকে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টাকে সমর্থন করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে মানবিক উদ্দেশ্যে সাহায্য বাড়ানো, সম্প্রদায় উন্নয়ন কর্মসূচি সমর্থন করা এবং মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ানো, যাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় কার্যকর অগ্রগতি সাধিত হয়।

বাংলাদেশ এক নিদারুণ সংকটকালে যেভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বাগত জানিয়েছে, তার তুলনা মেলা ভার। একটি নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে বাংলাদেশ এই ঝুঁকি গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তাই বলে, তাদের এই বোঝা আজীবন বহন করে যেতে হবে, তেমনটি আশা করা ঠিক নয়। বৈশ্বিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে কার্যকর সমর্থন প্রদান করতে হবে। অর্থায়নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদার সমর্থন এবং পুনর্বাসনের সম্ভাব্য সমাধান, পাশাপাশি মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘায়িত সংকটের কারণগুলোর সমাধান, এই রোহিঙ্গা সংকটের জন্য একটি টেকসই এবং ন্যায্য সমাধান নিয়ে আসতে পারে। রোহিঙ্গারা তাদের জন্মভূমি নিজ বাসভূমে ফিরে যেতে পারে না এবং তারা অস্থায়ীভাবে যেখানে আছে সেখানেও থাকতে পারে না। এই মধ্যবর্তী অনিশ্চিত অবস্থা একটি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ও বিকাশের জন্যে কতটা ভয়াবহ তা নিরূপণের মতো ঔদার্য কি বিবেকের ফেরিওয়ালা দেশগুলো দেখাতে পারে না? কেউই ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাসন বেছে নেবে না, যদি না সেখানে একটি বড় হুমকি থাকে। কেবল মিষ্টি কথায় এখানে চিড়ে ভিজবে না কিংবা উদাসীনতার চশমা পরে এই নির্মম বাস্তবতাকে এড়ানো যাবে না। একটি অস্তিত্বগত সমাধান কেবল অর্থপূর্ণ আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের মাধ্যমেই আসতে পারে

বাংলাদেশের অবস্থান আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং তা পরিচালনার ক্ষমতার ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আন্তর্জাতিক আইন সরকারগুলোর ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে, একই সঙ্গে নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা ব্যক্তিদের আশ্রয় দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করে। বাংলাদেশ তার দায়িত্ব পূরণে অসাধারণ কাজ করেছে। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশটি দায়িত্ব বিভাজনের মানবিক রীতি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে অন্তর্ভুক্ত করে এমন একটি অধিকতর ভারসাম্যপূর্ণ কৌশল খুঁজবে- সেটাই স্বাভাবিক।

লেখক : দ্বিভাষিক লেখক, কলামিস্ট, অনুবাদক, সাবেক উপাচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া


কিশোর-তরুণদের তামাক ও ধূমপানের নেশামুক্ত রাখতে হবে

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. অরূপ রতন চৌধুরী

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস-২০২৪ পালনে এ বছর প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে "চৎড়ঃবপঃ ঈযরষফৎববহ ভৎড়স ঞড়নধপপড় ওহফঁংঃৎু ওহঃবৎভবধৎবহপব" প্রতিপাদ্যের বাংলা ভাবানুবাদ করা হয়েছে- ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ প্রতিহত করি, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি।’ বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিপাদ্যটি যথার্থ এবং অত্যন্ত সময়োপযোগী। কারণ, শিশু-কিশোর, তরুণরা ধূর্ত তামাক কোম্পানিগুলোর প্রধান টার্গেট। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশ শিশু-কিশোর ও তারুণ্যের দেশ। বর্তমানে ৪৯% জনগোষ্ঠী বয়সে তরুণ, যে কারণে বাংলাদেশকে ‘ইয়ুথ ডিভিডেন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে জাতিসংঘ।

কিশোর-তরুণরাই আগামীর বাংলাদেশের রূপকার। এ কারণেই শৈশব ও কৈশোর পেরিয়ে যৌবন অর্থাৎ তারুণ্যে পদার্পণের সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণও বটে! ঝুঁকিপূর্ণ এ জন্যই যে, অল্প বয়সেই বেশির ভাগ তরুণ ছেলে-মেয়ে কৌতূহলবশত কিংবা প্ররোচনায় ধূমপানসহ ভয়াবহ মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ে, বিভিন্ন গবেষণায় যার প্রমাণ পাওয়া গেছে। হয়তো বা তার উপলক্ষ থাকে কোনো একটি বিশেষ দিন অথবা বিশেষ অনুষ্ঠান। হয়তো সে ভাবে- আজ শুধু আনন্দ, ফুর্তি করব। কাল থেকে আর ধূমপান/মাদক গ্রহণ করব না, প্রতিজ্ঞা করব। ধূমপান, মাদকের নেশা খুবই ক্ষতিকর, মারাত্মক আসক্তি সৃষ্টি করে। সিগারেট কোম্পানির প্ররোচনা ও কৌতূহলবশত যে শিশু-কিশোররা ধূমপানের জালে জড়িয়ে পড়ছে তাদের ফেরানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এখান থেকেই তারা ভয়াবহ মাদকের ফাঁদে আটকে যাচ্ছে। পথভ্রষ্ট হয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে পড়ছে, যদিও তারা অমিত সম্ভাবনাময় নিয়ে এসেছে পৃথিবীতে। এর ফলে সমাজে এখন ‘কিশোর গ্যাং’ অপসংস্কৃতির উদ্ভব ঘটছে। যা নিয়ে পুলিশ প্রশাসন এমনকি সরকারপ্রধানের উদ্বেগ যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলছে আমাদেরকে। শিশু-কিশোর, তরুণদের নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন। তারাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের কাণ্ডারি। জাতীয় অসংখ্য উদ্যোগ, লক্ষ্যমাত্রা এবং সেগুলোর সাফল্যও নির্ভর করছে তাদের ওপর।

ভিশন-২০২১-এ সাফল্যের দেখা পেয়েছে সরকার। সেটার ওপর ভিত্তি করেই রূপকল্প-২০৪১ ঘোষণা করা হয়েছে। সমাজের সব ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করা, দারিদ্র্য নির্মূল, মানসম্পন্ন শিক্ষার মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত, পুষ্টি বৈষম্য দূরীকরণ ও টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা এ রূপকল্পের উদ্দেশ্য। সুতরাং, স্বাভাবিকভাবেই ২০৪১ সাল সমগ্র জাতির জন্য আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কারণ ওই বছরেই উন্নত সমৃদ্ধ দেশের কাতারে শামিল হবে আমাদের মাতৃভূমি প্রিয় বাংলাদেশ। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ থেকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ লক্ষ্যমাত্রাও সেই একই বছরে। উপরন্তু, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন যে, ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে ‘তামাকমুক্ত দেশ’। তামাকের মতো অভিশাপ ও প্রতিবন্ধকতা মুক্ত উন্নত, সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ সবাই প্রত্যাশা করে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কোনো উন্নয়ন বা উদ্যোগ জনগণকে পাশ কাটিয়ে হতে পারে না। বিশেষ করে এ ক্ষেত্রে শিশু-কিশোর, তরুণদের উপেক্ষা করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। কেননা, আমাদের সার্বিক উন্নয়নে ‘এক্স ফ্যাক্টর’ হবে হালের অল্প বয়সীরা। কৈশোর ও তারুণ্যের মুন্সিয়ানা অনেক চমকপ্রদ হয়ে থাকে। আমরাও সে আলোকেই আশাবাদী হয়ে আছি। তবে সেই লক্ষ্য অর্জনে কতটা সাবধানতা অবলম্বন করছি, তা নিয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে কপালে। কারণ, শিশু-কিশোর ও তরুণদের বিপথগামিতা সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যা থেকে উত্তরণে সামনে আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। আর সে পরীক্ষায় বড় প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো। যারা ব্যবসায়িক স্বার্থ চরিতার্থ করার হিংস্র নেশায় আমাদের শিশু-কিশোর, তরুণদেরই বেছে নিয়েছে! প্রতিদিনই তারা বিভিন্নভাবে কিশোর-তরুণদের ধূমপানে আকৃষ্ট করতে নানা প্রলোভন দেখাচ্ছে।

সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৭ সালের তথ্য মতে, দেশে ৩৫.৩% (৩ কোটি ৭৮ লাখ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধূমপান বা তামাক সেবন করে। এর সঙ্গে আরও একটা অংশ রয়েছে, যারা এই গণনার বাইরে। অর্থাৎ শিশু-কিশোরদের মধ্যেও এই বদভ্যাস রয়েছে, যা অত্যন্ত মারাত্মক ও অশনিসংকেত! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত “এষড়নধষ ঝপযড়ড়ষ ইধংবফ ঝঃঁফবহঃ ঐবধষঃয ঝঁৎাবু-২০১৪” গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে ১৩-১৫ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের মধ্যে তামাক ব্যবহার করে ৯ দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্বে এই সংখ্যা ৩ কোটি ৮০ লাখ (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০২১)!

নাটক, সিনেমা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ধূমপানের দৃশ্য দেখে যা মনে হয়, শিশু-কিশোর ও তরুণদের মধ্যে ধূমপানের হার বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। নিজের বাসা ও অফিস সংলগ্ন স্বনামধন্য স্কুলের নবম-দশম শ্রেণির কিশোর ও কলেজের সদ্য ভর্তি হওয়া একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রদের ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় ভয়-ডরহীনভাবে হিরোদের মতো প্রকাশ্যে সিগারেট সেবন করতে দেখি প্রায়শই। সেই সঙ্গে ই-সিগারেটের ব্যবহার বেড়েছে অনেক। সিগারেটের ধোঁয়া অভিভাবক সমতুল্য বয়োজ্যেষ্ঠদের নাকে-মুখে ছুড়ছে অবলীলায়! প্রতিবাদ করলে নিজের ওপর বিপদ ধেয়ে আসতে পারে ভেবে অনেকে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়িয়ে চলেন।

‘মানস’ নামক সংস্থা এবং ব্যক্তিগতভাবে আমি গণমাধ্যমের সহায়তায় ধূমপানবিরোধী সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত আছি দীর্ঘ ৪০ বছরের অধিক সময় ধরে। সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে সচেতনতা সৃষ্টি করছি, যেন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সঠিকভাবে নিজেদের ক্ষতিকর কু-অভ্যাসগুলো থেকে দূরে রাখতে পারে। সরকারের জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোও চেষ্টা করছে। কিন্তু, জনপ্রিয় সেলিব্রেটিরা যাদেরকে শিশু-কিশোর, তরুণরা অনুসরণ ও অনুকরণ করে তারা কী করছে? প্রশ্নটা তাদের দিকেই ছুড়ে দিলাম, যারা সাধারণ মানুষের ভালোবাসা ও সহায়তা পেয়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে সিগারেট কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় প্রচারণা করছেন! দেখবেন, এখন হরহামেশাই জনপ্রিয় অভিনেতাদের মুখে, হাতে সিগারেট ধরিয়ে নাটক, চলচ্চিত্র এবং হালের জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজগুলোতে অযাচিতভাবে সিগারেট সেবনের দৃশ্য প্রচার করছেন। এ বছর ঈদুল ফিতরে মুক্তিপ্রাপ্ত ১১টি চলচ্চিত্রের অন্তত ৯টি চলচ্চিত্রে ধূমপানের দৃশ্য দেখানো হয়েছে। ‘কাহিনির প্রয়োজনে’ দোহাই দিয়ে মেগা স্টারদের হাতে সিগারেট এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেন এগুলো অত্যাবশ্যকীয় অনুসঙ্গ! ছোট পর্দার নাটক, টেলিফিল্মেও একই দশা। পালে বাতাস দিচ্ছে অভিনেত্রীরা। নাটক, চলচ্চিত্রে এবং বাস্তবে অনেক মেয়েকে এখন সিগারেট সেবন করতে দেখা যাচ্ছে। এগুলো অধিকার, না কি অপসংস্কৃতি তা ভেবে দেখতে হবে। বলা যায়, এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে তামাক কোম্পানিগুলো। বিনোদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ চলচ্চিত্র। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট শিল্পী, প্রযোজক-পরিচালকরা এমন কিছু করতে পারেন না, যা বৃহত্তর সমস্যার কারণ হতে পারে। কারণ, এতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ মেগাস্টারদের হাতে সিগারেট দেখেই এখনকার তরুণ-কিশোররা সিগারেট গ্রহণে আগ্রহী হয়।

শৈশব, কৈশোর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। যে সময়ে তারা নিজেকে গড়তে শিখে, যে সময়ে নিজেকে তৈরি করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সুবর্ণ সময় পার করে। তারুণ্যে অনেক স্বপ্ন এবং আশা থাকে। এটি উৎসাহের সময়, আত্মবিশ্বাসের উন্নতির সময়। যদি তারুণ্যের এই সময়ে সে কোনো ভুল করে বসে বা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারে, তবে তার পুরো জীবনটাই মূল্যহীন, বৃথা হয়ে যায়। তাই এই সময়ে যাতে তরুণরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং ভুল পথে পা না বাড়ায়, সে জন্য একটা সুন্দর দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। যেটা করতে পারেন অভিনয় শিল্পী, কলা-কুশলীরা। তো এরাই যদি অকারণে, অযাচিতভাবে বিনোদন মাধ্যমগুলোতে সিগারেট, এলকোহল ও মাদকের বিজ্ঞাপন চালায় তবে আমাদের আগামী প্রজন্ম রসাতলে যাবে। আইডলরা সচেতনভাবেই যদি শিশু-কিশোরদের মগজে ‘নেশার ইনজেকশন’ পুশ করতে থাকেন, তবে ফলাফল আরও ভয়াবহ হতে পারে। তখন নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো সচেতনতা কর্মসূচি চালিয়ে আসা আমাদের মতো লোকদের চেষ্টা বৃথা হয়ে যায়। কেননা, আমি ১০ জনকে তামাকের নেশা ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করেছি কিন্তু, তারা ১০০ জনকে উৎসাহিত করছে! আমাদের প্রচেষ্টা অনেকটা সমুদ্রে বালতি দিয়ে পানি সেচার মতো হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে পিতা-মাতার ভূমিকা অনেক বেশি। তারা সন্তানকে এ ব্যাপারে কথা বলবেন, সাবধান করবেন।

ইদানীং দেখা যায়, কিশোর-তরুণদের যাতায়াত বেশি এমন বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ‘ধূমপানের স্থান’ বেড়ে যাচ্ছে। মূলত, রেস্টুরেন্ট মালিকদের সুবিধা দিয়ে সেগুলো তৈরি করছে সিগারেট কোম্পানিগুলো। যেখানে ধূমপান থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাদকও সেবন করা হয়। ফলে তরুণদের মধ্যে সামাজিক রীতি-নীতি, মূল্যবোধ উঠে যাচ্ছে। পাশাপাশি এসব স্থানে পরিবার-পরিজন নিয়ে উপভোগ্য সময় কাটাতে আসা মানুষজন ভয়াবহ স্বাস্থ্যগত ক্ষতির শিকার হচ্ছে। ধূমপানের আখড়া তৈরি করে ব্যবসার প্রসার করাই মূল উদ্দেশ্য সিগারেট কোম্পানির। লক্ষ করলে দেখবেন, স্কুল-কলেজসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জনবহুল স্থান ও আশপাশে সিগারেটের দোকান, ভ্রাম্যমাণ দোকান বেশি। সিগারেট কোম্পানির কৌশলী বিজ্ঞাপন বাচ্চাদের চোখ সমান্তরালে প্রদর্শন করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা-৫ অনুসারে তামাকের সব ধরনের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ। স্থানীয় সরকার বিভাগের তামাক নিয়ন্ত্রণ নির্দেশিকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়কেন্দ্র নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারপরেও সিগারেট কোম্পানিগুলো যা করছে, তা রীতিমতো আইনের লঙ্ঘন ও রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ!

তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেটের ব্যবহার বাড়ছে। যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে সেটা রীতিমতো উদ্বেগজনক! মূলত, কয়েকটি সিগারেট কোম্পানি দেশে সুকৌশলে ই-সিগারেট বাজারজাত করতে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। নিরাপদ মনে করে অনেকে ই-সিগারেটের দিকে ঝুঁকছে। বিজ্ঞানের গবেষণায় বলা হয়েছে, ই-সিগারেটর জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। গ্রামাঞ্চলেও ই-সিগারেট বিপণন, ব্যবহার বাড়ছে। ফ্যাশন হিসেবে নিয়ে উঠতি বয়সীদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহার বাড়ছে। কেননা, ই-সিগারেট উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো এসব পণ্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং এর মধ্যে বিভিন্ন ফ্লেভার ব্যবহার করে থাকে। যা তরুণ ও উঠতি বয়সীদের আকর্ষণের মূল কারণ। টিসিআরসির তথ্যমতে, বাংলাদেশে ই-সিগারেট দোকানগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক গড়ে তোলা হয়েছে শুধু তরুণদের আকৃষ্ট করার জন্য। সিগারেট কোম্পানিগুলো বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় যে, ই-সিগারেট কম ক্ষতিকর। আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকায় ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হচ্ছে এবং ধূর্ত সিগারেট কোম্পানিগুলো সেটার সুযোগ নিচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, তামাক (বিড়ি, সিগারেট, জর্দ্দা, গুল, সাদাপাতা) ব্যবহারে দেহে ২৫টির বেশি প্রাণঘাতী রোগ হয়, যার অনত্যম হলো- ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যান্সার। দেশে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়, কয়েক লাখ মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে তামাকের কারণে। পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষয়ক্ষতিও অনেক বেশি। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস্) ২০১৭-তে দেখা যায়, ৩৫.৫% বা ৩ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ (৪৬% পুরুষ ও ২৫.২% নারী) তামাক সেবন করে। ১৮% বা ১ কোটি ৯২ লাখ মানুষ (পুরুষ ৩৬.২% ও নারী ০.৮%) ধূমপান করে এবং ২০.৬% বা ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ (পুরুষ ১৬.২% ও নারী ২৪.৮%) ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। বাড়ি, গণপরিবহন, কর্মক্ষেত্র ও জনসমাগমস্থল মিলিয়ে এই সংখ্যা প্রায় ৮ কোটি! আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি ও বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে ১৫ বছরের কমবয়সী ৪ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি শিশু তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। আশঙ্কাজনক তথ্য হলো, এর মধ্যে ৬১ হাজারের বেশি শিশু বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে বিভিন্ন অসুখে ভোগে। অর্থাৎ তামাকের কারণে সম্ভাবনাময় শিশু-কিশোররা বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই অভিভাবকদের আরও সচেতন হতে হবে, যাতে নিজের ভুলে সন্তানদের ভবিষ্যৎ হুমকিতে না পড়ে যায়!

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের আগামী প্রজন্মের ওপর খুবই আশাবাদী। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে তিনি বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নতি করতে চান। শিশু-কিশোর যারা তারুণ্যে পদার্পণ করছে, এই ট্রানজিশন প্রক্রিয়াটা তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারুণ্য জীবনকে মহাজীবনের দিকে পৌঁছে দেয়। তাই তরুণদের প্রতি আমার বার্তা হলো- ভিন্নভাবে চিন্তা ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শিখতে হবে। অর্থাৎ ভালো-মন্দ বিচারের ভার নিজেকেই নিতে হবে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম তরুণদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘ভিন্নভাবে চিন্তা করার ও উদ্ভাবনের সাহস থাকতে হবে, অপরিচিত পথে চলার ও অসম্ভব জিনিস আবিষ্কারের সাহস থাকতে হবে এবং সমস্যাকে জয় করে সফল হতে হবে। এসব মহান গুণের দ্বারা তরুণদের চালিত হতে হবে। নতুন প্রজন্মের প্রতি এই আমার বার্তা।’

রাষ্ট্র ও পরিবারের দিক থেকে তাদের যত্নে কোনো গাফিলতি করা যাবে না। কেননা, তামাক কোম্পানির মতো ধূর্ত হায়েনারা আমাদের শিশু-কিশোরদের ধরতে ওত পেতে বসে আছে। তাদের কূটচালে এই বিপুল জনগোষ্ঠী যদি জাতীয় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সমস্যায় জর্জরিত হবে রাষ্ট্র। সমস্যা থেকে উত্তরণ ও দীর্ঘমেয়াদে পদক্ষেপ হিসেবে তরুণদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে। তারুণ্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি সংশোধনী পাস করে বাস্তবায়নে জোর দেওয়া প্রয়োজন। তা হলেই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের যে সুবিধা পাওয়ার কথা, তা বাস্তবে ধরা দেবে। সুতরাং, বসে থাকার সময় নেই। তরুণদের রক্ষায় কাজ করতে হবে। মাদক ও তামাকের নেশায় নীল না হয়ে তরুণরা নিজেকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তাই বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসে আগামী প্রজন্মের সুরক্ষায় ধূর্ত তামাক কোম্পানিগুলোর সব ধরনের অপকৌশল প্রতিহত করার অঙ্গীকার করি।

লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দসৈনিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

বিষয়:

কোরবানির মাসায়েল

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মুফতি আলী হুসাইন

আরবি ‘কুরবুন’ মূলধাতু হতে কোরবানি শব্দের উৎপত্তি। এর আভিধানিক অর্থ নৈকট্য ও সান্নিধ্য লাভ অথবা সান্নিধ্য লাাভের উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত বস্তু।

শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে আল্লাহ তায়ালারই নামে নির্দিষ্ট তারিখে, নির্দিষ্ট নিয়মে, নির্দিষ্ট পশু জবাই করাকে কোরবানি বলা হয়।

কোরবানির গুরুত্ব ও ফজিলত

কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি আদায় করা ওয়াজিব। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি এ ইবাদত পালন করে না, তার ব্যাপারে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ‘যার কোরবানির সামর্থ্য রয়েছে কিন্তু কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ [মুস্তাদরাকে হাকীম, হাদিস নং- ৩৫১]

আয়েশা [রা.] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- কোরবানির দিনের আমলসমূহের মধ্য থেকে পশু কোরবানি করার চেয়ে কোনো আমল আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় নয়। কিয়ামতের দিন এই কোরবানিকে তার শিং, পশম ও ক্ষুরসহ উপস্থিত করা হবে। আর কোরবানির রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহ তায়ালার কাছে তা কুবল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে কোরবানি করো। [জামে তিরমিযি: ১৪ঝ৩]

কার ওপর কোরবানি ওয়াজিব

প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ জিলহজের ফজর থেকে ১২ জিলহজ ফজর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে, তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, অলঙ্কার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন পড়ে না এমন জমি, প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সব আসবাপত্র কোরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।

আর কোরবানির নেসাব হলো- স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে নেসাব হলোÑ সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন-অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। [আলমুহিতুল বুরহানি ৮/৪৫৫; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪০৫]

কোরবানিদাতার নখ-চুল না কাটা

কোরবানিদাতার জন্য কোরবানি করার পূর্বে নখ-চুল না কাটা মুস্তাহাব। উম্মে সালামা [রা.] বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি কোরবানি করতে ইচ্ছুক, সে যেন জিলহজের প্রথম দিন থেকে কোরবানি করার পূর্ব পর্যন্ত নখ, চুল ইত্যাদি না কাটে। [সহিহ মুসলিম:২/১৬০]

যেসব পশু দ্বারা কোরবানি করা যায়

উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ নয়। [ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫]

কোরবানির পশুর বয়সসীমা

উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়, আর এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয়, তাহলে তা দ্বারাও কোরবানি করা জায়েজ। অবশ্য এ ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়সের হতে হবে। পক্ষান্তরে ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে

কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কোরবানি জায়েজ হবে না। [ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫-২০৬]

শরীকি কোরবানি

সাত বা সাতের কম শরিক মিলে কোরবানি করলে সবার অংশ সমান হতে হবে। কারও অংশ এক সপ্তমাংশের কম হতে পারবে না। যেমন কারও আধা ভাগ, কারও দেড় ভাগ। এ ক্ষেত্রে কোনো শরিকের কোরবানিই সহিহ হবে না। [বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭]

উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কোরবানি করা জায়েজ। [সহিহ মুসলিম, হাদিস ১৩১৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭]

কেউ যদি আল্লাহর হুকুম পালনের উদ্দেশে কোরবানি না করে শুধু গোশত খাওয়ার নিয়তে কোরবানি করে, তাহলে তাকে অংশীদার বানালে কারও কোরবানি হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অংশীদার নির্বাচন করতে হবে। [বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৮; কাযীখান: ৩/৩৪ঝ]

আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বায় একজনের বেশি শরিক হয়ে কোরবানি করা যায় না। এগুলো একটা একজনের নামেই কোরবানি করতে হয়।

শরিকদের কারও পুরো বা অধিকাংশ উপার্জন যদি হারাম হয়, তাহলে কারও কোরবানি সহিহ হবে না।

কোরবানির গরু, মহিষ ও উটে আকিকার নিয়তে শরিক হতে পারবে। এতে কোরবানি ও আকিকা দুটোই বিশুদ্ধ হবে। অবশ্য কোরবানির পশুতে আকিকার জন্য শরিক না নেওয়া ভালো। [বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০ঝ]

শরীকি কোরবানির গোশত অবশ্যই ওজন করে সমানহারে বণ্টন করতে হবে। অনুমান করে গোশত বণ্টন করা জায়েজ

নেই। [কাযীখান: ৩/৩৫১]

রুগ্ণ ও দুর্বল পশুর কোরবানি

কোরবানির পশু হৃষ্টপুষ্ট হওয়া উত্তম। [মুসনাদে আহমাদ: ৬/১৩৬; বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২১০]

এমন কেনো দুর্বল পশু, যা জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না, তা দ্বারা কোরবানি করা জায়েয নয়। [জামে তিরমিযী ১/২৭৫; আলমগীরী ৫/২ঝ৭; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৪]

গরু-ছাগলের অধিকাংশ দাঁত না থাকলেও যে কয়টি দাঁত আছে, তা দ্বারা যদি ঘাস চিবিয়ে খেতে পারে তবে সেটি দ্বারা কোরবানি করা সহিহ। কিন্তু দাঁত পড়ে যাওয়ার কারণে যদি ঘাস চিবিয়ে খেতে না পারে তবে ওই পশু কোরবানি করা যাবে না। [বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৫; ফাতাওয়া আলমগীরী ৫/২ঝ৮]

যে পশুর শিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙে গেছে, যে কারণে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সে পশুর কোরবানি জায়েজ নয়। কিন্তু শিং ভাঙার কারণে মস্তিষ্কে যদি আঘাত না পৌঁছে তাহলে সেই পশু দ্বারা কোরবানি জায়েজ। তাই যে পশুর অর্ধেক শিং বা কিছু শিং ফেটে বা ভেঙে গেছে বা শিং একেবারে উঠেইনি, সে পশু দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ। [জামে তিরমিযী ১/২৭৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৩৮৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬]

কান বা লেজ কাটা পশুর কোরবানি- যে পশুর লেজ বা কোনো কান অর্ধেক বা তারও বেশি কাটা, সে পশুর কোরবানি জায়েজ নয়। আর যদি অর্ধেকের কম হয়, তাহলে তার কোরবানি জায়েজ। তবে জন্মগতভাবেই যদি কান ছোট হয় তাহলে অসুবিধা নেই। -জামে তিরমিযী ১/২৭৫; মুসনাদে আহমাদ ১/৬১০; ইলাউস সুনান ১৭/২৩৮; ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৫২; আলমগীরী ৫/২ঝ৭-২ঝ৮]

গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মাসায়ালা

মৃতের পক্ষ থেকে কোরবানি- মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কোরবানি করা জায়েজ। মৃত ব্যক্তি যদি ওসিয়ত না করে থাকে তবে

সেটি নফল কোরবানি হিসেবে গণ্য হবে। কোরবানির স্বাভাবিক গোশতের মতো তা নিজেরাও খেতে পারবে এবং আত্মীয়-

স্বজনকেও দিতে পারবে। আর যদি মৃত ব্যক্তি কোরবানির ওসিয়ত করে গিয়ে থাকে তবে এর গোশত নিজেরা খেতে পারবে না। গরিব-মিসকিনদের মাঝে সদকা করে দিতে হবে। [মুসনাদে আহমাদ ১/১০৭,

কোরবানির গোশত, চর্বি ইত্যাদি বিক্রি করা জায়েজ নয়। বিক্রি করলে পূর্ণ মূল্য সদকা করে দিতে হবে। [ইলাউস সুনান ১৭/২৫ঝ; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৫; আলমগীরী ৫/৩০১]

বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তির জন্য নিজ দেশে বা অন্য কোথাও কোরবানি করা জায়েজ।

কোরবানিদাতা এক স্থানে আর কোরবানির পশু ভিন্ন স্থানে থাকলে কোরবানিদাতার ঈদের নামাজ পড়া বা না পড়া ধর্তব্য নয়; বরং পশু যে এলাকায় আছে ওই এলাকায় ঈদের জামাত হয়ে গেলে পশু জবাই করা যাবে। [আদ-র্দুরুল মুখতার ৬/৩১৮

কাজের লোককে কোরবানির গোশত খাওয়ানো- কোরবানির পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া জায়েজ নয়।

গোশতও পারিশ্রমিক হিসেবে কাজের লোককে দেওয়া যাবে না। অবশ্য এ সময় ঘরের অন্য সদস্যদের মতো কাজের

লোকদেরকেও গোশত খাওয়ানো যাবে। [আহকামুল কুরআন জাস্সাস ৩/২৩৭; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪]

জবাইকারীকে পারিশ্রমিক দেওয়া- কোরবানির পশু জবাই করে পারিশ্রমিক দেওয়া-নেওয়া জায়েজ। তবে কোরবানির পশুর

কোনো অংশ পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া যাবে না। [কিফায়াতুল মুফতী ৮/২৬৫]

কেউ যদি কোরবানির দিনগুলোতে ওয়াজিব কোরবানি দিতে না পারে, তাহলে কোরবানির পশু ক্রয় না করে থাকলে তার ওপর কোরবানির উপযুক্ত একটি ছাগলের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। আর যদি পশু ক্রয় করেছিল, কিন্তু কোনো কারণে কোরবানি

দেওয়া হয়নি তাহলে ওই পশু জীবিত সদকা করে দেবে। [বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৪]

কোরবানির গোশত বণ্টন পদ্ধতি

কোরবানি করা আর কোরবানির গোশত দান করা পৃথক পৃথক দুটি আমল। সহিহ নিয়তে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পশু জবাই করলে কোরবানির ওয়াজিব আমল আদায় হয়ে যায়। আর গোশতের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ বলেছেন- তোমরা কোরবানির গোশত খাও, জমা করে রাখো এবং (অসহায়-দরিদ্রদের) দান করো। [মুসলিম: ১/৭১]

তবে দানের ব্যাপারে শরিয়ত কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ করেনি; বরং প্রত্যেককে তার সামর্থ্য অনুপাতে দান করতে বলা হয়েছে। অবশ্য সামর্থ্যবানদের জন্য স্বাভাবিক অবস্থায় উত্তম হলো, মোটামুটি তিন ভাগ করে এক অংশ গরিব-মিসকিন ও অসহায়দেরকে দান করা, এক অংশ গরিব আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের দেওয়া আর এক অংশ নিজের জন্য রাখা।

আবদুল্লাহ ইবনে আববাস [রা.] থেকে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) তার কোরবানির গোশতের তিন ভাগের এক ভাগ নিজের পরিবার-পরিজনকে দিতেন। আরেক ভাগ গরিব প্রতিবেশীদের এবং এক ভাগ ভিক্ষুক ও অসহায়দের দান করতেন। [আল-মুগনি:১৩/৩৭]

উল্লেখ্য যে, তিন ভাগ করা আবশ্যক নয় বরং এটি একটি মুস্তাহাব আমল। তাই সামর্থ্যবানদের এ পদ্ধতির ওপর আমল করা উচিত। কারও পরিবারের সদস্য বেশি হলে কিংবা নিজেদের প্রয়োজন বেশি থাকলে সে ক্ষেত্রে কোরবানির সম্পূর্ণ গোশত নিজেরা খেতে পারবে। এটা তাদের জন্য অনুত্তম হবে না। [ফাতাওয়া তাতারখানিয়া: ১৭/৪৩৭; রদ্দুল মুহতার: ৬/৩২৮]

অধিকাংশ এলাকায় ‘সামাজিক অংশ’ নামে কোরবানির একটা অংশ এক জায়গায় একত্রিত করা হয়, তারপর সেগুলো সবার মাঝে অর্থাৎ যারা কোরবানি করেছে আর যারা কোরবানি করেনি প্রত্যেককেই এক অংশ করে দেওয়া হয়, ফলে কেমন যেন কোরবানিদাতা গোশত দান করে আবার সেই গোশতের অংশ ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ফিরিয়ে নেয়। এটা ভুল পদ্ধতি; অবশ্যই পরিবর্তন ও সংশোধনযোগ্য। কেননা কাউকে কিছু দিয়ে ফিরিয়ে নেওয়া গর্হিত কাজ এবং নিচু মানসিকতার পরিচয়। হাদিসে এসেছে- ‘যে ব্যক্তি দান করে তা আবার ফেরত নেয়, সে ওই ব্যক্তির মতো, যে বমি করে তা পুনরায় মুখে তুলে নেয়। [মুসলিম: ১৬২২; বুখারি: ২৬২১]

কোরবানির পশু জবাই করা প্রসঙ্গে

পশুকে প্রয়োজন অতিরিক্ত কষ্ট না দেওয়া। তাই পশুকে ধরা, শোয়ানো ও জবাইয়ের কাজগুলো এভাবে করা উচিত যেন পশুর অতিরিক্ত কষ্ট না হয়। [সহিহ মুসলিম: ১/৫৫]

জবাইয়ের সময় পশুর মাথা দক্ষিণ দিকে রেখে কিবলামুখী করে বাম কাতে শোয়ানো এবং জবাইকারীর কিবলামুখী হয়ে জবাই করা (সুন্নাতে মুয়াক্কাদা)। [মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৮৫৮৭, রদ্দুল মুহতার: ১/৪২৭]

জবাইয়ের জন্য ধারালো অস্ত্র বা ছুরি ব্যবহার করা। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আল্লাহ তায়ালা সবকিছু সুন্দর করে সম্পাদন করার নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব, যখন তোমরা হত্যা করবে, তো উত্তম পদ্ধতিতে হত্যা করো। আর যখন জবাই করবে তখন উত্তম পদ্ধতিতে জবাই করো। প্রত্যেকে তার ছুরিতে ধার দেবে এবং তার পশুকে আরাম দেবে। [সহিহ মুসলিম: ১/৫৫]

প্রাণীর সামনে ছুরি ধার না দেওয়া এবং এক প্রাণীর সামনে আরেক প্রাণী জবাই না করা। [মুসন্নাফে আব্দুর রযযাক: ৮৬০৬]

কোরবানির পশুকে মাটিতে শুইয়ে তার মুখ কিবলামুখী করে দোয়া পাঠ করে জবাই করবে।

কেউ দোয়া পড়তে না পারলে শুধু ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করলেও চলবে। [বুখারি: ৫৫৫৮]

জবাইয়ের মধ্যে পশুর চারটি রগ কাটতে হবে। তিনটি কাটলেও হবে কিন্তু তিনটা রগের কম কাটলে সে পশু মৃত বলে গণ্য হবে এবং তা খাওয়া হারাম হয়ে যাবে। রগ চারটি হলো- শ্বাসনালি, খাদ্যনালি ও দুটি শাহরগ। [হেদায়া: ৪/৪৩৪]

জবাই করার পর পশু পুরোপুরি ঠাণ্ডা বা নিস্তেজ না হওয়া পর্যন্ত চামড়া খসানো, হাত-পা কাটা, ভাঙা কিংবা সমস্ত গলা কেটে ফেলা মাকরূহ। [রদ্দুল মুহতার: ৯/৪২৭, বাদায়েউস সানায়ে: ৪/১৮৮-৯০]

কোরবানিদাতা নিজে জবাই করা উত্তম। নিজে না পারলে অন্যকে দিয়েও জবাই করাতে পারবে। এক্ষেত্রে কোরবানিদাতা পুরুষ হলে জবাইস্থলে তার উপস্থিত থাকা ভালো। [মুসনাদে আহমাদ: ২২৬৫৭; বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২২২-২২৩

লেখক: ইসলামী চিন্তাবিদ

বিষয়:

আইনের শাসন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সৈয়দ শাকিল আহাদ

দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ ১৮/১১/১৮ইং তারিখে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে অপরাধীদের সঠিক বিচার নিশ্চিতের বিকল্প নেই’, তিনি আরও বলেন, ‘আইনের শাসন রাষ্ট্রভেদে সামাজিক, আর্থিক এবং সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে আপাতদৃষ্টিতে ভিন্ন মনে হলেও চূড়ান্ত বিচারে অপরাধের শাস্তি নিশ্চিতের কোনো বিকল্প নেই। অপরাধীদের শাস্তির মাত্রা দেশ-কাল-পাত্রভেদে ভিন্ন হতে পারে। তবে আইনের শাসন যেখানে রয়েছে সেখানে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হয়।’

কথাটির যথার্থতা পেয়েছি, দেশের আপামর জনগণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, যারাই দুর্নীতি করেছেন কোনো না কোনোভাবে তা লোকচক্ষুর সামনে এসেছে এবং অপরাধী চিহ্নিত হয়েছেন সঙ্গে সাজাও ভোগ করেছেন এবং কেউ কেউ সাজা ভোগ করে চলেছেন।

আইনের শাসন বলতে আমরা বুঝি রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিবিশেষ, যেখানে সরকারের সব ক্রিয়াকর্ম আইনের অধীনে পরিচালিত হয় এবং যেখানে আইনের স্থান সব কিছুর ঊর্ধ্বে। ব্যবহারিক ভাষায় আইনের শাসনের অর্থ এই যে, রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার সর্বদা আইনানুযায়ী কাজ করবে, যার ফলে রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিকের কোনো অধিকার লঙ্ঘিত হলে সে তার প্রতিকার পাবে। মোট কথা, আইনের শাসন তখনই বিদ্যমান থাকে, যখন সরকারি ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অনুশীলন সাধারণ আদালতের পর্যালোচনাধীন থাকে, যে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার অধিকার সব নাগরিকের সমান।

দেশভেদে আইনের শাসনের বিভিন্ন প্রকারভেদ লক্ষ্য করা যায়। ইংল্যান্ডে যেসব সাধারণনীতি দ্বারা আইনের শাসন নিশ্চিত হয়েছে তার অধিকাংশই সেখানকার নাগরিকদের আদালতে উত্থাপিত বিভিন্ন মামলার বিচার বিভাগীয় রায়ের ফসল। ওইসব রায়ে নাগরিকদের ব্যক্তিগত অধিকার নির্ধারিত হয়েছে। এ ছাড়া ম্যাগনা কার্টা (১২১৫), দ্য পিটিশন অব রাইটস (১৬২৮) এবং বিল অব রাইটসে (১৬৮৯) ইংরেজদের স্বাভাবিক অধিকারগুলো ঘোষিত হয়েছে, যা ওই দেশের আইনের শাসন নিশ্চিত করে। ইংরেজ জাতির ঐতিহ্য, রীতিনীতি, ব্যবহারবিধি এবং তাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশের দীর্ঘ ইতিহাসের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগত অধিকার সম্পর্কে ইংরেজদের সচেতনতা গড়ে উঠেছে। সেগুলো পরবর্তীকালে সৃষ্ট অনেক নতুন রাষ্ট্রের লিখিত সাংবিধানিক দলিলের মতোই পবিত্র ও অলঙ্ঘনীয়। অধিকাংশ নতুন রাষ্ট্রের সংবিধানে ইংরেজদের ওইসব অলিখিত নীতিমালা সন্নিবেশিত হয়েছে।

দেশে আইনের শাসন আছে, সবাইকেই আইন মেনে চলতে হবে এবং আইন তার নিজস্ব গতিতেই এগিয়ে চলে, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, আদালতের রায়ের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে, আমরা দেশবাসী ও সারা বিশ্ব দেখেছি, দুর্নীতি মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও নিস্তার পাননি, দেখেছি সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকেও ছাড় দেওয়া হয়নি।

ইদানিং ছাড় পাননি সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদও এই পুলিশপ্রধানের দুর্নীতি ফাঁস হওয়ায় আদালত কর্তৃক একটি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশের তদন্তে অনেক অজানা অন্যায়ের তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে এবং প্রধানমন্ত্রীর পর্যবেক্ষণে আদালত কর্তৃক সাবেক পুলিশপ্রধানের যাবতীয় সম্পত্তি ক্রোক ও ব্যাংকে সব ধরনের লেনদেন স্থগিত করার আদেশ জারি করা হয়।

বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের সম্পত্তি জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির একটি আদালত।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আস-শামস জগলুল হোসেন এ আদেশ দেন।

এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন কমিশনের এক কর্মকর্তা। সম্প্রতি আদালতে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তার পক্ষ থেকে লিখিত আবেদন করা হয়েছিল। আদালত আইন-কানুন দেখে নথি দেখে জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন।

বেনজীর আহমেদ বাংলাদেশ পুলিশের একজন সাবেক কর্মকর্তা যিনি পুলিশের ৩০তম মহাপরিদর্শক ছিলেন। তিনি ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

সম্প্রতি বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ওঠে।বাংলাদেশের কয়েকটি পত্রিকায় এ সম্পর্কে প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়।তারই ধারাবাহিকতায় গত মাসে মি. আহমেদের সম্পদ অনুসন্ধানে কাজ শুরু করে দুদকের তিন সদস্যের একটি কমিটি।

সাবেক আইজিপি দুর্নীতি নিয়ে স্থানীয় পত্রিকায় করা প্রথম প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল, ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’। প্রতিবেদনে রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার পুরস্কারপ্রাপ্ত পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদের নানা অর্থ-সম্পদের বিবরণের তথ্য তুলে ধরা হয়েছিল।

এর মধ্যে রয়েছে, গোপালগঞ্জের সাহাপুর ইউনিয়নে সাভানা ইকো রিসোর্ট নামের এক অভিজাত ও দৃষ্টিনন্দন পর্যটনকেন্দ্র। প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই রিসোর্টে এক রাত থাকতে গেলে গুনতে হয় অন্তত ১৫ হাজার টাকা।

পুলিশের সাবেক এই প্রভাবশালী শীর্ষ কর্মকর্তা, তার স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ছয়টি কোম্পানির খোঁজ পাওয়া গেছে। পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার বেশি বলে ধারণা পাওয়া গেছে।

এ ছাড়া ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোতে রয়েছে বেনজীর আহমেদের দামি ফ্ল্যাট, বাড়ি আর ঢাকার কাছেই দামি এলাকায় বিঘার পর বিঘা জমি। দুই মেয়ের নামে বেস্ট হোল্ডিংস ও পাঁচতারা হোটেল লা মেরিডিয়ানের রয়েছে লক্ষাধিক শেয়ার বলেও ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

সেখানে বলা হয়, অথচ ৩৪ বছর ৭ মাসের দীর্ঘ চাকরিজীবনে বেনজীর আহমেদ বেতন-ভাতাবাবদ মোট আয় করেছেন ১ কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার ২০০ টাকা। এর বাইরে পদবি অনুযায়ী পেয়েছেন আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা। পরবর্তীতে বেনজীর আহমেদ তার ফেসবুক পাতায় এসব অভিযোগ অস্বীকার করে একটি ভিডিওবার্তা প্রকাশ করেন।

সে তার সমগ্র সম্পদ জব্দের আওতায় আসছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে দুদক আইনজীবী বলেন, মামলাটি এখন অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে। অনুসন্ধান পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগে বলা যাবে না সব সম্পত্তি এর মধ্যে রয়েছে কি না।

‘মোট ৮৩টি দলিলের প্রোপার্টি, বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে এই তালিকায়। কক্সবাজারের একটি প্রোপার্টি রয়েছে’। এটিকে বিশেষ কোনো অগ্রগতি হিসেবে না দেখে তদন্ত কাজের একটা অংশ হিসেবে দেখতেই আগ্রহী। বেনজীর আহমেদ সম্প্রতি একটি ভিডিওবার্তা প্রকাশ করেন, শিরোনাম দেন ‘আমার কিছু কথা’।

সেখানে মি. আহমেদ বলেন, ‘সম্প্রতি পত্রিকান্তরে আমার এবং পরিবারের বিরুদ্ধে কিছু খুবই আপত্তিজনক, মানহানিকর, অসত্য এবং বিকৃত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।’

অবসর গ্রহণের দুই বছর পরে ‘আকস্মিক’ এমন ‘একটি মানহানিকর, অসম্মানজনক, অসত্য সংবাদ’ পরিবেশনের কারণ নিয়ে অবশ্য আলোচনা করতে চাননি তিনি।

সাবেক পুলিশপ্রধানের দাবি, তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, ‘তার মধ্যে ২৪টি তথ্য বা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা বা কল্পনাপ্রসূত। দুটি বিষয়কে সাতবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে এবং দুটি তথ্যকে ভুল প্রেক্ষাপটে বিকৃতভাবে পরিবেশন করা হয়েছে। বাকি ১০টি অভিযোগ বা তথ্যকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে শুধু তিলকে তাল নয়, তালগাছের ঝাড়সমেত ভুলভাবে উপস্থান করা হয়েছে।’

২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর অবসরে যান বেনজীর আহমেদ। চাকরিজীবন থেকেই মি. আহমেদ নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত।২০২১ সালে র‍্যাব ও তার ছয় কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। যার অন্যতম বাহিনীটির সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ।

তখন মার্কিন বিবৃতিতে বলা হয়, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত থাকার জন্য বেনজির আহমেদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করার কথা ঘোষণা করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর- যার ফলে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অযোগ্য হবেন।

দুদকের সাহসী পদক্ষেপ যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছে যেমন- নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নামে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ করেছে গ্রামীণ ব্যাংক। এতে বলা হয়, নিজের মালিকানাধীন পারিবারিক প্রতিষ্ঠান প্যাকেজেস করপোরেশনকে বহুবিধ অবৈধ সুবিধা প্রদান করেছেন ড. ইউনূস। দুদক সেই অভিযোগ প্রমাণেও নিরঙ্কুশ ভূমিকা রাখে।

দেশে আইনের শাসন কায়েম আছে, সুশাসন বইছে এবং কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, আলোচিত সাবেক পুলিশপ্রধানের বিচারকার্যই তা প্রমাণ করে ফলে সরকারের বিভিন্নপর্যায়ের অনেক দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা সতর্ক হয়ে চলছেন, প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, দুর্নীতিকে জিরো টলারেন্স, সাধুবাদ জানাই দুদককে, উপলব্ধি করছি সেই সঙ্গে জনগণের মনে আশ্বস্থতা আরও বেড়েছে এবং শ্রেণিভেদে সবাই আইন ও বিচার বিভাগের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আছেন।

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক

বিষয়:

বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর দীর্ঘদিনের সুনাম কেন টার্গেট হচ্ছে?

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

গত ২৫ এপ্রিল ব্যাংককে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের এসকাপের ৮০তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। এ বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের যুদ্ধবিরোধী অবস্থান আরও পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেন। যদিও তিনি এ ভাষণটি দিয়েছেন জাতিসংঘের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনে (এসকাপ), কিন্তু সমগ্র বিশ্বকে সামনে রেখেই তিনি বক্তব্য রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে কয়েকটি দিক স্পষ্ট। প্রথমত, তিনি অত্যন্ত স্পষ্ট ও জোরালভাবে যুদ্ধকে ‘না’ বলার কথা বলেছেন। কারণ যুদ্ধ মানেই হচ্ছে ধ্বংস, সহিংসতা, আগ্রাসন। এ যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্ব একটি চরম সংকটে উপনীত হয়েছে। শেখ হাসিনা যথার্থই যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে জোরাল বক্তব্য রেখেছেন।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত প্রায় এক দশক ধরে বিশ্বশান্তি ও শৃঙ্খলার পক্ষে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রতিনিয়ত বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। বিগত দুই বছর জাতিসংঘে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের সরাসরি আহ্বান জানান। এমনকি তিনি যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব উল্লেখ করে এ বছরেও অনেক ফোরামে বক্তব্য তুলে ধরেছেন। যুদ্ধের ভয়াবহতা, যুদ্ধের কারণে অস্ত্র প্রতিযোগিতা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, মানবতার পতন এবং যুদ্ধের দরুন যে ধরনের অবিশ্বাস ও বৈরিতা তৈরি হয়েছে- সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন ফোরামে শান্তির পক্ষে বক্তব্য রাখছেন। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ অবদান রয়েছে। বাংলাদেশের এই অবদান বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ শান্তিরক্ষা বাহিনী (১৯৮৮-২০২৪) জাতিসংঘের অধীনে ৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে সশস্ত্র ও পুলিশ বাহিনীর প্রায় ৭ হাজার সদস্য শান্তি বজায় রাখার জন্য বিশ্বজুড়ে ৯টি মিশনে কাজ করছেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মোতায়েনে সবচেয়ে বেশি শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী রাষ্ট্র হিসেবে বেশ সুনাম রয়েছে।

১৯৭৩ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় একটি মেডিকেল মিশন পাঠান শান্তি বজায় রাখার উদ্দেশ্যে। জাতিসংঘ ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘ ইরান-ইরাক মিলিটারি অবজারভেশন গ্রুপ (ইউএনআইএমওজি) মিশন প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশ অপারেশনে ১৫ জন সামরিক পর্যবেক্ষক পাঠায়। ১৯৯৩-১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডা, সোমালিয়া এবং বসনিয়ায় সর্বাধিক আলোচিত শান্তি মিশনে নিজেদের শক্তি ও সক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেড গ্রুপ ১৯৯৪ সালের গণহত্যার সময় রুয়ান্ডায় অবস্থান করে। প্রায় ১০০ দিনের গৃহযুদ্ধে প্রায় ৮ লাখ মানুষ মারা যায়। সেই মিশনে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে বেলজিয়ানসহ আফ্রো-ইউরোপীয় ব্যাটালিয়নগুলো দ্রুত চলে যায় এবং তাদের অপারেশন স্থগিত করে; কিন্তু বাংলাদেশি সেনারা বীরত্বের সঙ্গে মিশন অঞ্চলে থেকে যায়। ফলে গণহত্যায় মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল। বাংলাদেশি সেনাদের সাহসিকতা ও দক্ষতা দেখে সবাই বিস্মিত হয়। মার্কিন সেনারা সোমালিয়া থেকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন প্রত্যাহার করার সময় তাদের শেষকর্মী সোমালিয়া ছেড়ে না যাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশি সেনাদের তাদের সঙ্গে থাকতে বলেছিল।

এ ছাড়া অসংখ্য উল্লেখযোগ্য মিশনে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর অসাধারণ অবদান রয়েছে। যেসব অবদানের কথা এই লেখায় সম্পূর্ণভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হলো- ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’। কারণ আমরা এমন একটি দেশ যারা শান্তিকে মূল্য দেয়। সিয়েরা লিওন বাংলাকে তাদের জাতির অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে। কারণ তারা বাংলাদেশি সেনাদের গুরুত্ব স্বীকার করেছে। অনেক দেশে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের এখন বীর হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা বাংলাদেশের ওপর বড় ধরনের অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলছে। বর্তমানে, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মোতায়েনের মাধ্যমে জাতির জন্য ২ হাজার কোটিরও বেশি টাকা রেমিট্যান্স এনেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে শান্তি এনে দিয়ে সেসব জাতির জনগণের সম্মান অর্জন করছে। জাতিসংঘের কার্যক্রম এবং বহুজাতিক বাহিনীর প্রতি স্বতন্ত্র অঙ্গীকারের কারণে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নত হয়েছে।

এত সব অর্জন এবং অবদানের মধ্যেও গত ২১ মে জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলে (ডিডব্লিউ) বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও র‌্যাবকে নিয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ‘হিউম্যান রাইটস অ্যাবিউজারস গো অন ইউএন মিশনস’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ডয়েচে ভেলের রিপোর্টের শুরুতে জাতিসংঘ মিশনের জন্য বাংলাদেশের সেনা ও পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কিছু ভিডিও দেখানো হয়। প্রামাণ্যচিত্রে বিতর্কিত মার্কিন মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) এশিয়া বিভাগের উপপরিচালক মিনাক্ষী গাঙ্গুলীকে বলতে দেখা গেছে, ‘যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে তাদের পাঠানো উচিত না।’ এ ছাড়া প্রতিবেদনের শেষ দিকে ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কায় তামিল বিদ্রোহ দমনের কিছু ছবি দেখিয়ে সে সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত শাভেন্দ্রা সিলভাকে দেশটির সেনাপ্রধান করার কারণে তাদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে স্থগিত হওয়ার কথা বলা হচ্ছে (অনলাইন সময় নিউজ ২২ মে ২০২৪)। কিন্তু সবাইকে বুঝতে হবে যে শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশের অবস্থা নয়। একটি ডকুমেন্টারিতে কীভাবে বলা যেতে পারে- জাতিসংঘের শান্তি মিশনে সংশ্লিষ্টদের পাঠানো উচিত না। একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রতিবেদনে কিংবা ডকুমেন্টারিতে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত উল্লেখ করার মতো বিষয়টি মানানসই নয়। তাহলে কি ধরে নেওয়া যায় না, ডকুমেন্টারিটি একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে একটি বিশেষ মহলের প্ররোচনায় সম্পাদিত হয়েছে! বিষয়টি এসব দিক বিবেচনা করলে পরিষ্কার ধারণা করা যায় যে ডকুমেন্টারিকে শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের সেনা পাঠানো বন্ধের বিষয়টি সামনে আনার অপচেষ্টা রয়েছে।

ওপরে উল্লেখ করেছি, বাংলাদেশ সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে জাতিসংঘ মিশনে কাজ করে চলেছে। তাদের বিশ্বব্যাপী প্রশংসা রয়েছে। মিশনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাংলাদেশের বীরত্ব ও ত্যাগের ইতিহাসও বেশ লম্বা। এ পর্যন্ত মোট ১৬৬ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষা মিশনে নিহত হয়েছেন বলে তথ্য রয়েছে।

এতসব ইতিবাচক দিক থাকার পরেও ডয়েচে ভেলে ও নেত্রনিউজ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে মাঠে নেমেছে সেটি নিয়ে একটি বড় প্রশ্ন সামনে এসেছে।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশ থেকে লোক না নেওয়ার ষড়যন্ত্র অনেক আগেই শুরু হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনকেন্দ্রিক সব ষড়যন্ত্র বিফলে যাওয়ার পর তারা এ ধরনের নেতিবাচক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছেন। এটি যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের নীরব কূটনীতি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।

গত বছরের জুনে ডিডব্লিউ র‌্যাবকে নিয়ে আরেকটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করে এবং জাতিসংঘের মিশন থেকে এর সদস্যদের বাদ দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করার চেষ্টা করেছিল। এ ছাড়া দোহাভিত্তিক আল-জাজিরার ‘অল প্রাইম মিনিস্টারস ম্যান’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে তাদের। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সেনাবাহিনীকে নিয়ে কল্পনাপ্রসূত খবর প্রকাশ করা হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্ভাবনী চিন্তা ও দূরদর্শী নেতৃত্বের গুণে অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে মানবিক বাংলাদেশ আজ নতুন মর্যাদায় বিশ্বদরবারে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার মানবিক কূটনীতিও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ইতিহাসে নতুন দৃষ্টান্তের সৃষ্টি করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা ইস্যুতে মানবিক সংস্কৃতির বাংলাদেশকে তুলে ধরলে বিষয়টির গুরুত্ব বিশ্ব রাজনীতি ও বাংলাদেশে বেড়ে যায়। শেখ হাসিনা তার ভাষণে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা, খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের আহ্বান জানিয়েছেন বারবার। তারপরও বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে কোনো গণমাধ্যমে প্রশ্ন তোলার বিষয়টিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলা যায় নিঃসন্দেহে। বর্তমানে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের নতুন গুরুত্ব তৈরি হয়েছে। বর্তমান বিশ্বসংকটকে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, পরিবেশগত কিংবা সামরিক যেভাবেই আমরা বিবেচনা করি না কেন, সেখানে এশিয়ার দেশগুলোর একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা এশিয়ার অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় আলাদা। এসব কারণেই হয়তো বাংলাদেশকে চাপে ফেলতে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী নিয়ে বিতর্ক উসকে দেওয়ার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী তথা নিরাপত্তা বাহিনীর বিশ্বব্যাপী দীর্ঘদিনের যে সুনাম রয়েছে তা মূলত প্রশ্নবিদ্ধ করতেই এক ধরনের নতুন ষড়যন্ত্র তৈরি হয়েছে বলে সুস্পষ্টভাবে অনুমান করা যায়।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাসের সিগনালিং পদ্ধতি ও প্রচার 

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মো. হুমায়ুন কবীর

বছরের বিভিন্ন সময়ে বঙ্গোপসাগরের উত্তাল আবহাওয়ার দরুন বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকায় সামুদ্রিক ঝড়ের আঘাত আসে। প্রলয়ঙ্করীরূপে সেসব ঝড়ের কবলে পড়ে বিনষ্ট হয় অনেক সম্পদ, প্রাণহানী হয় অনেক মানুষের। স্মরণাতীতকালের মধ্যে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের সেই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের কথা মনে করা যেতে পারে। সেই ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে উপকূলীয় সব জেলার প্রায় দশ লাখ মানুষের প্রাণ গিয়েছিল সেদিন।

তারপর আইলা, সিডর, নার্গিস, রোয়ানুর এবং সর্বশেষ রেমালের কথা আমরা সবাই জানি। এগুলোর মাধ্যমে যেমন নষ্ট হয়েছে সম্পদ, তেমনি গেছে মানুষের প্রাণও। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের বিশ্বঐতিহ্য ও একমাত্র ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। তবে আগের তুলনায় এখন আবহাওয়া বিভাগ আরও বেশি তৎপর ও পূর্বাভাস প্রদানে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কারণে অনেক আগে থেকে তা জানা যাচ্ছে। সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পূর্বাভাস ও সরকারি-বেসরকারি সবপর্যায় থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে ক্ষয়-ক্ষতি আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে।

কিন্তু বর্তমানে যে প্রচলিত ধারায় ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস সম্পর্কিত সতর্কতামূলক সিগনালিং ব্যবস্থা মিডিয়ায় প্রচার করা হয়ে থাকে তা মোটেও সাধারণ নাগরিকদের জন্য সহজবোধ্য নয়। সেটিকে যদি আরও বিশ্লেষণধর্মী, সুনির্দিষ্ট উপদ্রুত এলাকায় এবং অন্য সব এলাকার সর্বসাধারণের জন্য বোধগম্যভাবে উপস্থাপন করা যায়, তবে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক কমে যেতে বাধ্য। তা ছাড়া এখন এগুলোর সারমর্ম ভালোভাবে আয়ত্ত করতে না পারার কারণে সিগন্যাল ও সতর্কবার্তা আগে-ভাগে পেলেও তাতে মানুষের রেসপন্স কম পেতে দেখা গেছে।

দেখা গেছে, দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত পেয়েও মানুষ তার নিজের বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চাচ্ছে না। এখন সমুদ্রবন্দরের জন্য যত সংকেত এবং সেগুলো নিয়ে আলোকপাত করব- উপকূলে সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দিতে আবহাওয়া অধিদপ্তর ঝড়ের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন সতর্কতা সংকেত জারি করে থাকে। ঝড়ের গতি ও বিপদের সম্ভাব্য মাত্রা বিবেচনায় ১ থেকে ১১ নম্বর পর্যন্ত সংখ্যা দিয়ে উপস্থাপিত সংকেতগুলো ব্যাখ্যা করে একটি তালিকা প্রকাশ করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

এ ছাড়া বাতাসের গতিবেগের ওপর ভিত্তি করে বায়ুচাপ ও ঝড়ের শ্রেণিবিন্যাস করেছে তারা। সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটারের (কিমি) অধিক হলে সেটিকে ঘূর্ণিঝড় বলছে অধিদপ্তর। বাতাসের গতিবেগ ১৭-৩০ কিমি হলে লঘুচাপ, ৩১-৪০ কিমি হলে সুস্পষ্ট লঘুচাপ, ৪১-৫০ কিমি নিম্নচাপ, ৫১-৬১ কিমি গভীর নিম্নচাপ, ৬২-৮৮ কিমি ঘূর্ণিঝড়, ৮৯-১১৭ কিমি তীব্র ঘূর্ণিঝড়, ১১৮-২১৯ কিমি হ্যারিকেন এবং বাতাসের গতিবেগ ২২০ কিমি বা তার বেশি হলে তা হবে সুপার সাইক্লোন।

সমুদ্রবন্দরের জন্য সংকেতগুলো- (১) ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত: বঙ্গোপসাগরে দূরবর্তী এলাকায় একটি ঝড়ো হাওয়ার অঞ্চল রয়েছে। সেখানে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৬১ কিলোমিটার, যা পরিণত হতে পারে সামুদ্রিক ঝড়ে। (২) ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত: দূরে গভীর সাগরে একটি ঝড় সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে বাতাসের একটানা গতিবেগ ৬২-৮৮ কিমি। বন্দর এখনই ঝড়ে কবলিত হবে না, তবে বন্দর ত্যাগকারী জাহাজ বিপদে পড়তে পারে। (৩) ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত: বন্দর ও বন্দরে নোঙর করা জাহাজগুলো দুর্যোগকবলিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বন্দরে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। ঘূর্ণি বাতাসের একটানা গতিবেগ হতে পারে ৪০-৫০ কিমি।

(৪) ৪ নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত: বন্দর ঘূর্ণিঝড় কবলিত। বাতাসের সম্ভাব্য গতিবেগ ৫১-৬১ কিমি। তবে ঘূর্ণিঝড়ের প্রস্তুতি নেওয়ার মতো তেমন বিপজ্জনক সময় এখনো আসেনি। (৫) ৫ ও ৬ নম্বর বিপদ সংকেত: ঝড়ো বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিমি। ঝড়টি বন্দরকে বামদিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করতে পারে। (৬) ৭ নম্বর বিপদ সংকেত: ঝড়ো বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিমি। ঝড়টি বন্দরের ওপর বা কাছ দিয়ে অতিক্রম করতে পারে।

(৭) ৫, ৬ ও ৭ নম্বর সংকেত একই মাত্রার। এখানে শুধু পার্থক্য হলো ঝড় কোন দিক দিয়ে যাবে তার ওপর। (৮) ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত: বন্দর সর্বোচ্চ তীব্রতার ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে নিপতিত। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিমি বা তার বেশি হতে পারে। প্রচণ্ড ঝড়টি উপকূলকে বামদিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করতে পারে। (৯) ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত: বন্দর সর্বোচ্চ তীব্রতার ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এক সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে নিপতিত। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিমি বা তার বেশি হতে পারে। প্রচণ্ড ঝড়টি উপকূলকে বামদিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করবে।

(১০) ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত: বন্দর সর্বোচ্চ তীব্রতার ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এক সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে নিপতিত। বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিমি বা তার ঊর্ধ্বে হতে পারে। প্রচণ্ড ঝড়টি বন্দরের ওপর বা কাছ দিয়ে উপকূল অতিক্রম করবে। তেমনিভাবে ৮, ৯ ও ১০ নম্বর বিপদ সংকেতের মাত্রাও প্রায় একই রকম। (১১) ১১ নম্বর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার সংকেত: আবহাওয়া বিপদ সংকেত প্রদানকারী কেন্দ্রের সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আবহাওয়া অত্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের ব্রিটিশ শাসনামলে এবং বাংলাদেশের শাসনামলে তৈরি পর্যায়ক্রমিক এই সংকেতব্যবস্থা আন্তর্জাতিক সংকেতব্যবস্থা থেকে একটু ভিন্ন। তারপরও যুগোপযোগী হওয়ার কারণে এসব সংকেতের অর্থ জানা থাকলে সতর্কতা অবলম্বন করতে আরও সহজ হবে। কাজেই সতর্কতা সংকেতের তাৎপর্য শুধু ঝড়ের সময়ে না হয়ে সারাবছর এবং শুধু আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওপর ছেড়ে না দিয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন, পৌর প্রশাসনসহ সরকারি-বেসরকারি সবপর্যায় থেকে সবার কাছে ভালোভাবে বার্তাটি শিখিয়ে-পড়িয়ে ও বুঝিয়ে দিতে হবে। তাহলেই মৃত্যুর সংখ্যা যেমন কমে ১০ লাখ থেকে সর্বনিম্ন ২৪ জনে নেমে এসেছে, তা একেবারে শূন্যের কোটায়ও আনা সম্ভব হবে।

এবারের ঘূর্ণিঝড় রেমালের বিষয়টি আবহাওয়া অধিদপ্তর প্রায় দুসপ্তাহ আগে থেকেই পূর্বাভাস দিয়ে আসছিল। সে জন্য ধারাবাহিকভাবে সিগনালিং বিষয়ে সতর্কতা ও প্রচার এখানে একটি বিরাট ভূমিকা রেখেছে। পূর্বাভাসের তথ্যানযায়ী কোথায় কি পরিমাণ ঝড়ো হাওয়া, বৃষ্টিস্নাত, বাতাসের গতিবেগ, জলোচ্ছ্বাস, জলাবদ্ধতা ইত্যাদি বিষয়ে আগে থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করা গেছে যাতে জান-মালের ক্ষয়-ক্ষতি অনেকাংশে কমে গেছে। সে জন্য রেমালে উপকূলীয় অপ্রতিরোধ্য ক্ষয়-ক্ষতি তো হয়েছেই; কিন্তু সিগনালিংয়ের প্রচার ঠিকমতো না হলে হয়তো আরও অনেক বেশি ক্ষতি হতে পারত। সে জন্য সর্বশেষ খবরে সর্বোচ্চ আটজন মানুষের মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এটাই সময়মতো ও সঠিকভাবে সিগনালিংয়ের প্রচার নিশ্চিত করার সুফল। আশাকরি তা ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা রাখি।

লেখক: কৃষিবিদ ও রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয়:

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জন এফ কেনেডি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রাশিদুল হাসান

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর, আমেরিকান স্বাধীনতা যুদ্ধের মহানায়ক জর্জ ওয়াশিংটন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ১৭৮৯ সালের ৩০ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও সম্পদশালী রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। যেসব রাষ্ট্রনায়কের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অসাধারণ দূরদর্শিতার এবং সাহসিকতার ফল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমতাধর ও সম্পদের উচ্চ শিখরে উপনিত হয়েছে- তন্মধ্যে জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিংকন, ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট, থমাস জেফারসন, উড্রো ইউলসন, থিয়ডর রুজভেল্ট, হ্যারি এস ট্রুম্যান ও ডি আইসেন আওয়ার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

আমেরিকান ইতিহাস গড়ার কারিগর ও অসাধারণ রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে কেনেডি একজন ক্যারিশমাটিক ব্যক্তিত্ব, সুদর্শন ও অনলবর্ষী বক্তা। দ্বিতীয় সর্ব কনিষ্ঠতম প্রেসিডেন্ট জন ফিটজেরাল্ড কেনেডি। যিনি জন এফ কেনেডি নামে সুপরিচিত।

জন ফিটজেরাল্ড কেনেডি ১৯১৭ সালের ২৯ মে ম্যাসাচুয়েটমের ব্রুকলিনে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম জোসেফ প্যাট্রিক কেনেডি। তার বাবা প্রখ্যাত ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। তার মায়ের নাম রোস এলিজাবেথ। জন এফ কেনেডি ১৯৪০ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীতে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত লেফটেন্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় টর্পেডো স্কোয়াড্রন-২-এর নৌ-কমান্ডারের দায়িত্ব সাহসিকতার সঙ্গে পালন করেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে কেনেডি ১৯৪৫ সালে নৌবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে জ্যাকুলিন বোভিয়রের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কেনেডি জানুয়ারি ১৯৪৭ থেকে জানুয়ারি ১৯৫৩ সালের হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ হিসেবে ডেমোক্রেটদের প্রতিনিধিত্ব করেন। পরে তিনি ১৯৫৩ সালের ৩ জানুয়ারি থেকে ১৯৬০ সালের ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত সিনেটরের দায়িত্ব পালন করেন। তিনিই প্রথম আইরিশ আমেরিকান প্রেসিডেন্ট। কেনেডি একমাত্র আমেরিকান প্রেসিডেন্ট যিনি ‘প্রোফাইল ইন ক্যারেজ’ বই লেখায় সাহিত্যিক হিসেবে পুরিৎজাত পুরস্কার প্রাপ্ত হন। ১৯৬০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেট প্রার্থী হিসেবে কেনেডি মনোয়ন পান। প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পান। ইলেকট্রলাল কলেজ ভোটে কেনেডি ৩০৩ ভোট এবং নিক্সন ২১৯ ভোট পান।

জন এফ কেনেডি ১৯৬১ সালের ২০ জানুয়ারি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তখন তার বয়স মাত্র ৪৩ বছর। প্রবীণ রাজনীতিবিদদের পর কেনেডির আগমনে হোয়াইট হাউস যেন তারুণ্যের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে।

১৯৬২ সালের ১৪ অক্টোবর, গোয়েন্দা তথ্য থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রকে লক্ষ্য করে সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক কিউবায় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বসানো হয়েছে। এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র কিউবা থেকে উৎক্ষেপণ করা হলে কয়েক মিনিটের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলের অনেকাংশে আঘাত হানতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাদের মূল ভূখণ্ড থেকে মাত্র ৯০ মাইল দূরে অবস্থিত কিউবার এ অবস্থান মেনে নিতে পারছিল না। যুক্তরাষ্ট্র জানতে পারে ১৯৬২ সালের জুলাইয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র চালান পাঠানো শুরু করেছে। কিউবা দ্বীপের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের ইউ-২ গোয়েন্দা বিমানের মাধ্যমে ২৯ আগস্টের মধ্যে নতুন সামরিক নির্মাণ এবং সোভিয়েত প্রযুক্তিবিদদের উপস্থিতি রিপোর্ট করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৪ অক্টোবর একটি উৎক্ষেপণ সাইটে একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উপস্থিতি রিপোর্ট করা হয়েছিল। ১৬ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট কেনেডি নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও উপদেষ্টাদের এক জরুরি সভা আহ্বান করেন। অধিকাংশ উপদেষ্টারা কিউবায় আক্রমণের পক্ষে মতামত দিলেও কেনেডি বিশ্বশান্তি ও যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে কিউবা আক্রমণের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করেন। ২২ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট কেনেডি জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রতি ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় মাত্রার সামরিক সতর্কতা জারি করেন। ২৫ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্রের আরও সোভিয়েত চালান ঠেকাতে নৌ ‘সংগনিরোধ’ বা নৌ-অবরোধ আরোপ করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৪টি কিউবাগামী জাহাজ দেশে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। দুই পরাশক্তি পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছার মুহূর্তে কেনেডি ও ক্রুশ্চেভ চরম উত্তেজনার মধ্য দিয়ে বার্তা বিনিময় হয়েছিল। ২৮ অক্টোবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী এবং সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ফাস্ট সেক্রেটারি নিকিতা ক্রুশ্চেভের মধ্যে সমঝোতা হওয়ার পর কিউবা থেকে রাশিয়া ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নেওয়ার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র কিউবায় আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি দেন। ২৮ অক্টোবর বিকেল থেকেই কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি ভেঙে ফেলা শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর পূর্বক সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৬২ সালের ২০ নভেম্বর কিউবা থেকে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রত্যাহার এবং যুক্তরাষ্ট্র একই সময় তুরস্ক ও ইতালি থেকে জুপিটার ক্ষেপণাস্ত্র প্রত্যাহার করে নেয়। উপরোক্ত সমঝোতা চুক্তি যুক্তরাষ্ট্র, কিউবা, সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা সমগ্র বিশ্বকে একটি অবশ্যম্ভাবী পারমাণবিক যুদ্ধ থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। যা কেনেডির অসাধারণ রাজনৈতিক দূরদর্শিতার এবং কূটনৈতিক সাফল্য বলে বিবেচিত হয়। কিউবা সংকটের শান্তিপূর্ণ পরিসমাপ্তি হয় (সূত্র: সম্পাদক, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা)।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা বর্ষণের বিভীষিকাময় স্মৃতি, বিশ্বে ৭ কোটি মানুষের ভয়াবহ মৃত্যুর আলোকে কেনেডি হৃদয় দিয়ে বিশ্বশান্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৬৩ সালের ৫ আগস্ট মস্কোতে - যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য পারমাণবিক পরীক্ষা সীমিতকরণ চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। চুক্তিপত্রে উল্লেখ থাকে, ভূ-পৃষ্ঠের অভ্যন্তরে পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো যাবে। কিন্তু ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগে এবং জলরাশির নিচে পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো নিষিদ্ধ করা হয়।

আমেরিকার পূর্ববর্তী সরকারের সময় যুক্তরাষ্ট্রে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২.২৫ শতাংশ এবং কেনেডি সরকারের সময় প্রবৃদ্ধির হার ৫.৫ শতাংশে উন্নিত হয়। তৎকালীন সময় বেকারত্বের সংখ্যা কমানো সম্ভব হয়নি।

১৯৬৩ সালে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের নেতৃত্বে আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগোতে থাকে। ১৯৬৩ সালের ১১ জুন, প্রেসিডেন্ট কেনেডি টেলিভিশন ভাষণে বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে ও ভোটদানের ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ সব নাগরিকের সমান অধিকার সংরক্ষণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। ১৯৬৩ সালে ২৩ আগস্ট, লিংকন মেমোরিয়ালের সামনে কয়েক লাখ লোকের বিশাল জনসভায় ড. মার্টিন লুথার কিং এক ঐতিহাসিক ও হৃদয়স্পর্শী ভাষণ দেন, পরবর্তীতে তাই পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। প্রেসিডেন্ট কেনেডির আমন্ত্রণে, জনসভা সমাপ্ত হওয়ার পরই লুথার কিংসহ নেতারা হোয়াইট হাউসে জন এফ কেনেডি স্বাগত জানান এবং তাদের দাবির প্রতি পুনঃসমর্থন ব্যক্ত করেন।

১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর, টেক্সাসের ডালাসে এক মোটর শোভা যাত্রায় নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। ডালাসের আকাশে কালো মেঘ, তখন দুপুর ১২টা ৩০ মিনিট। গাড়ির বহর ডিলে প্লাজা অতিক্রম করছিল। পর পর দুটি গুলি, দ্বিতীয়টি তার মাথায় লাগে। রক্তাক্ত অবস্থায় তিনি গাড়িতে লুটিয়ে পড়েন। তাৎক্ষণিকভাবে পার্কল্যান্ট হসপিটাল নিয়ে যাওয়া হয় এবং ৩০ মিনিট পর কর্তৃপক্ষ জন এফ কেনেডিকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই ঘটনায় জড়িত থাকার অপরাধে লি হার্ভে অসওয়াল্ডকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি আমেরিকার নৌবাহিনীর সাবেক সদস্য ছিলেন। ২৪ নভেম্বর পুলিশের হেফাজতে থাকাকালে একটি নাইট ক্লাবের মালিক জ্যাক রুবির গুলিতে লি হার্ভে অসওয়াল্ড নিহত হন।

আমেরিকান নাগরিক অধিকার আইনের প্রধান রূপকার ও বিশ্বশান্তি এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অন্যতম মহানায়ক জন এফ কেনেডির হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত নিষ্ঠুর, বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক। জন এফ কেনেডি যুক্তরাষ্ট্র তথা বিশ্বের ইতিহাসে অম্লান ও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

লেখক: প্রাক্তন সাংগঠনিক সম্পাদক, জাতীয় চার নেতা পরিষদ ও কলামিস্ট।


ক্রলিং পেগ বা হামাগুড়ি সীমারেখা খুটা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব

আভিধানিক অর্থে ক্রলিংয়ের বাংলা অর্থ হলো- হামাগুড়ি। আর পেগের মানে হলো আটকানো পেরেক বা খুটা। এবার এই যে মানি মার্কেটে ক্রলিং পেগ পদ্ধতিটি ব্যবহার করা হয়েছে। সেটি বলার আগে ডলারের দাম ওঠানামা নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ডলারের হার নির্ধারণ করা হতো। এতে দেখা গেছে, যে হার নির্ধারণ করে দেওয়া হতো, তাতে ডলারের সরবরাহ কম বলে খোলা বাজারে (কার্ভ মার্কেট) অধিক হারে ক্রয়-বিক্রয় হতো এবং এই কারণে মানি মার্কেটে অনাহুত সমস্যাসহ নানাবিধ জটিলতা সৃষ্টি হতো। তাছাড়া অধিক হার বা দর পাওয়ার আশায় প্রবাসীরা এই খোলা বাজারের দিকে ঝুঁকে পড়ত বিধায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রেমিট্যান্স তথা ডলার বেহাত হয়ে যেত, যা সরকারের ঘরে আসত না। এদিকে এ বিষয়টি নিয়ে বহুদিন ধরে আইএমএফ বলে আসছে, ডলারের রেট এভাবে নির্ধারণ না করে মুদ্রা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হোক। এ ক্ষেত্রে ডলারের হার চাহিদা ও যোগানের মাধ্যমে একটি পয়েন্টে নির্ধারণ হবে। অথচ দেশের আর্থ-সামাজিক প্যারামিটার বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ পথে আগায়নি; কিন্তু এবার আইএমএফের কথা না মেনে উপায় ছিল না। কেননা তুমি তো জানো, বাংলাদেশ অনেকাংশে বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীল। তাই শর্তানুযায়ী কাম্য ঋণ পাওয়ার স্বার্থে একরকম বাধ্য হয়ে এই ক্রলিং পেগ পদ্ধটি প্রবর্তন করতে হয়; কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ক্রলিং পেগের আওতায় মুদ্রা বাজারে ছেড়ে দেওয়া হলেও সুতার গুটি কিছুটা হাতে থাকে। এখানে একটি কথা না বললেই নয়। মূলত অস্থিতিশীল মুদ্রা বাজারে সমতা আনতে এই আপৎকালীন ক্রলিং পেগ ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রে ডলারের দাম তলানিতে গিয়েও ঠেকবে না। আবার আকাশচুম্বীও হবে না। আবার তোমার কথায় ফিরে আসি। রূপক অর্থে যদি বলি, তাহলে বলতে হয় যে এই ক্রলিং তথা হামাগুড়ি দিয়ে ইচ্ছে করলেই বহুদূর আগানো যাবে না। এর একটি সীমারেখা অর্থাৎ একটি খুটা গাড়া আছে। এগোতে গেলে বড়জোর সেই সীমারেখা বা খুটা পর্যন্ত যাওয়া যাবে। আর তাই ক্রলিং ও পেগের আওতায় এই পদ্ধতির নাম দেওয়া হয়েছে ক্রলিং পেগ। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্থতায় এতদিন প্রতি ডলার ১০৯.৫০ কিনে সর্বোচ্চ ১১০.০০ টাকা বিক্রি করতে মানি মার্কেটকে বলা হতো। পূর্বেই বলেছি, বেশির ভাগ ব্যাংক এ হারের প্রতি অনীহা এবং বলতে গেলে তেমন মানেনি। তাই আইএমএফের শর্তসহ সবকিছু বিবেচনায় এনে এক লাফে ৭.০০ টাকা বাড়িয়ে ১১৭.০০ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যদি ঘুরিয়ে বলি, তাহলে কথাটি এই দাঁড়ায় যে, খুটা তথা পেগ সংবলিত হার ১১৭.০০ টাকা; এর বেশি আর আগানো যাবে না।

ডলার বা অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে দুই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় যেমন- হার্ড পেগ এবং সফট পেগ। বস্তুত হার্ড পেগ পদ্ধতি সরকার তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার হার নিজেই ঠিক করে দেয়, যা আগে করা হতো। কিন্তু সফট পেগ পদ্ধতি মুদ্রা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হলেও সরকার তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্ভাব্য হার নির্ধারণ করে দিতে পারে। আর এই সূত্র ধরে ক্রলিং পেগের কথা উঠে আসে। তা ছাড়া ডলারের মান সম্পূর্ণ বাজারমুখী রাখতে হস্তক্ষেপবিহীন ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট ব্যবহার করা হয়। এতে দেশের অর্থনীতি ও মুদ্রা বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডলারের দাম ওঠা-নামা করে। আসলে দোস্ত আজিজ, এতক্ষণ যত কথাই বলি না কেন, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক, বলতে গেলে খুব একটা সুবিধার নয়। আর তাই হার্ড পেগ বা সফট পেগ বা ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট পদ্ধতি যাই বলো না কেন; বর্তমানে দেশের মূল্যস্ফীতিসহ মুদ্রার অবমূল্যায়ন প্রকট আকার ধারণ করেছে বলেই ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার মান নির্ধারণ করা হয়েছে।

চলতি বছরের বিগত সময় ধরে কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও হঠাৎ করে এখন ডলার বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে, যে কথা তুমি আমাকে ফোনে বলেছিলে। দেখা যাচ্ছে, ভালো করতে গিয়ে উল্টো ফল। এই ক্রলিং পেগের কারণে নতুন দর নির্ধারণের পর কার্ব মার্কেট থেকে বলতে গেলে ডলার উধাও হয়ে গেছে। কোথাও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। মুদ্রা বাজারে ডলারের সংকটে বৈদেশিক বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ার অবস্থায় পৌঁছে গেছে। আমদানির ক্ষেত্রে এলসি খুলতে ব্যবসায়ীদের গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত দর ১১৭ টাকা হলেও বাস্তবে ১২৪ থেকে ১২৫ টাকার নিচে কোনো ব্যাংক এলসি খুলতে চাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মুদ্রা তথা ডলার বাজারে হঠাৎ এ অস্থির পরিস্থিতির কারণে কেবল বৈদেশিক বাণিজ্যই নয়- দেশের মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলার আশঙ্কা আছে। আর এই কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠতে পারে। অবশ্য এর মধ্যেই সে আলামতও দেখা যাচ্ছে, বলতে গেলে সব জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বগতি। ইতোমধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশে পৌঁছেছে। যাহোক, আগেই কিছুটা আলোকপাত করেছি যে গত ০৮/০৫/২০২৪ তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংক এক ধাপে ডলারের বিনিময় হার ৭ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। তাতে ১১০ টাকার স্থলে ১১৭ টাকা আন্তঃব্যাংক দর নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আশ্চর্য বিষয় হলো, এ ঘোষণার পরদিন থেকেই খোলাবাজার থেকে ডলার এক প্রকার উধাও হয়ে যায়। এতে বিদেশগামী যাত্রীরা চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছেন এবং এখনো হচ্ছেন। তবে অতিরিক্ত দাম দিলে কোথাও কোথাও ডলার পাওয়া যাচ্ছে। আর ব্যাংকগুলোতেও ডলার সংকট সৃষ্টি হওয়ায় বেশির ভাগ ব্যাংক এলসি খুলতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছে। আরেকটি কথা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ ঘোষণার কারণে ভবিষ্যৎ মুনাফা পাওয়ার আশায় অসাধু ব্যবসায়ীরা ডলার মজুতের দিকে ঝুঁকে পড়েছে বিধায় বলতে গেলে ডলার সোনার হরিণ হয়ে দাঁড়ায়। বিদেশে যাতায়াত ও চিকিৎসার খরচ মেটাতে খোলাবাজারে ১ ডলারের জন্য ১২৮ টাকা পর্যন্ত ক্রেতাদের পকেট থেকে চলে যাচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত হারে ডলার কেনার বিষয়ে সতর্ক করার পরও ব্যাংকগুলোয় ডলারের সংকট আরও গভীর হয়। এ ক্ষেত্রে নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রায় ১৫ টাকা বেশিতে, অর্থাৎ প্রতি ডলার ১২৮ টাকায় বিক্রি হতে থাকে। খোলাবাজারে ডলারের এ রেকর্ড পরিমাণ দাম সম্পর্কে নানা কথা শোনা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উচ্চ হারে ডলারের লেনদেনের পেছনে থাকা অবৈধ ডলার ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে তথ্য নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এই ডলার সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা চাহিদা অনুযায়ী আমদানির এলসিও খুলতে পারছেন না, যা অর্থনীতির জন্য শুভ নয়। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে দেশের আমদানি কমার হার ছিল ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের গত ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানি কমার হার প্রায় ৩০ শতাংশে পৌঁছে। আর ২০২১-২২ অর্থ বছরে প্রতি মাসে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি হতো, বর্তমানে হচ্ছে তার অর্ধেক। আর এর জের হিসেবে চাহিদা অনুযায়ী মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি করতে না পারায় দেশের অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে; যা প্রকারান্তরে অর্থনীতির চাকা প্রায় স্থবির করে তুলছে।

এ প্রেক্ষাপটে তথ্য মতে জানা যায়, ডলার বাজার কিছুটা স্থিতিশীল ছিল গত কয়েক মাস। তবে ব্যাংকগুলো কখনোই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত দরে এলসি খুলতে আগ্রহী ছিল না। কেননা তারা কাগজপত্রে যে দর দেখায়, বাস্তবে তার চেয়ে বেশি দিতে হয়। আর ১১০ টাকার নির্ধারিত দর থাকার সময় কোনো ব্যাংক এ দরে এলসি খুলতে সম্মত হলেও অতিরিক্ত টাকা দিলেই কেবল এলসি খুলতে রাজি হতো এবং এ ক্ষেত্রে খোলাবাজার থেকে অতিরিক্ত ডলার কিনে দিতে হতো। তারা জানান, ঋণপ্রবাহ সংকুচিত হওয়া; সুদহার বৃদ্ধি; ডলার সংকট ও ডলারের বিনিময় হার নিয়ে নৈরাজ্যর কারণে প্রত্যাশিত মাত্রায় ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পারা; গ্যাস সংকট এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে বিক্রি কমে যাওয়াসহ বহুমুখী সংকটে বেসরকারি খাত এখন বিপর্যয়ের দিকে এগোচ্ছে। তাই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দেশের ব্যাংক খাতের আর্থিক ভিত আরও বেশি নড়বড়ে হয়ে উঠবে বলে প্রতীয়মান হয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতেও দেশের ব্যাংক খাতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল সর্বোচ্চ ৮৫ টাকা; কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রলিং পেগের আওতায় অনুমোদিত দর অতিক্রম করে প্রতি ডলার ১২৮ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। অবশ্য ঘোষিত দরে দেশের কোনো ব্যাংকেই ডলার মিলছে না। এদিকে আমদানিকারকদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো ডলার প্রতি ১২৪-১২৫ টাকাও আদায় করছে বলে অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ উঠেছে। আর এটি যদি হিসাব করি, তাহলে দেখা যায়, এ সময়ে ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ। আর এই বিনিময় হার নিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে দেশের ব্যবসায়ীদের ক্ষতি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি বলেন, ‘বাজারভিত্তিক সুদহার চালু করায় নতুন করে বিনিয়োগ বাড়বে না। একই সঙ্গে খরচ বাড়বে ব্যবসার। ডলারের দাম বাড়ায় রপ্তানিকারকরা কিছুটা লাভবান হলেও আমদানির খরচ বাড়বে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের এ পদক্ষেপের ফলে কস্ট অব ডুয়িংস বিজনেস বা ব্যবসার খরচ বাড়বে বলে সেটা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ ব্যবসার খরচ বাড়লে জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বাড়বে। নতুন করে তো বিনিয়োগ বাড়বে না বরং উল্টো খরচ বাড়বে। ডলারের দাম যেভাবে ওঠানামা করছে, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও নজরদারি বাড়াতে হবে। আর ডলারের সাময়িক ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকগুলোতে ডলার সরবরাহ বাড়াতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। এর মধ্যে ডলার ব্যবসায়ীরা বৈদেশিক মুদ্রার দর আরও বাড়ার খোঁজ পেয়ে গেছেন বিধায় তারা স্টক রাখার পরও ডলার ঘাটতির কথা বলছেন। বস্তুত খোলাবাজারে বিনিময় হার সব সময়ই ব্যাংকের চেয়ে বেশি থাকে। কখনো কখনো বাজার তদারকির অভাবে তা অস্বাভাবিক পর্যায়ে বেড়ে যায়। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বলা হচ্ছে, নগদ ডলারের পর্যাপ্ত মজুত ও সরবরাহ ঠিক আছে। আর এখানে কে বিক্রি করবে বা কে করবে না, এটা তাদের নিজস্ব বিষয়। তা ছাড়া আরও বলা হচ্ছে, যে মানি এক্সচেঞ্জার ডলার পাননি, তারা ব্যাংকে গেলেই ডলার কিনতে পারবেন। কেননা ব্যাংকগুলোর কাছে এখন ৫ কোটি নগদ ডলার মজুত আছে। আসলে ডলারের এই অস্থিতিশীল পরিবেশ নিয়ে বিভিন্ন কর্নার থেকে কথার শেষ নেই। এ ব্যাপারে ডলারের দামকে পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়ে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, সময় মতো ডলারের দাম বাজারভিত্তিক না করা এবং পুরো রপ্তানি আয় দেশে না আসায় সংকট যাচ্ছে না। তা ছাড়া বাণিজ্য ঘাটতি কাটছে না ও আর্থিক হিসাবেও ঘাটতি বাড়ছে। ফলে ডলারের সংকট কাটছে না ও রিজার্ভের পতন হচ্ছেই। ডলারের দাম নির্ধারণে যে ধরনের নীতি নেওয়া হয়েছে, তার কোনোটাই টেকসই হচ্ছে না। এখন নতুন ক্রলিং পেগ পদ্ধতিও বাজারভিত্তিক না। ডলারকে চাহিদা ও যোগানের সঙ্গে ওঠানামা করতে দিতে হবে। ব্যাংকগুলোকে প্রতিদিন দামের ঘোষণা দিতে হবে, এতে গ্রাহকরা পরিষ্কার ধারণা পাবেন। তা ছাড়া ডলার সংকট নিরসনে একটি পথনকশা করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা মেনে নিলে সংকট নিরসন হওয়ার পথ সুগম হবে।

যত কথাই বলি না কেন, এ বিশ্বে ছোট-বড় মিলে প্রায় ১৯৫টি দেশ আছে। আর এমনও অনেক দেশ আছে, তারা পুরাপুরি পরনির্ভরশীল; কিন্তু আমরা তেমনটি নই। কেননা আমাদের অর্থনৈতিক শক্ত ভিত আছে। তাই মনে করি, ডলারের প্রবাহ বেড়ে গেলে এটি পশমিত হয়ে যাবে। আর অর্থনীতির এ ধরনের ওঠানামার ঢেউ শুধু গরিব বা উন্নয়নশীল দেশ নয়, উন্নত বিশ্বেও হয়ে থাকে। আসলে আমাদের বড় অভাব হলো আন্তরিকতা ও নৈতিকতা। এ ক্ষেত্রে সামাজিকই বলো, আর আর্থিকই বলো, কোনো কিছু ঘটলে তাই নিয়ে তিলকে তাল করার স্বভাব। আর এর সুযোগ নেয় কতিপয় সুবিধাবাদী চক্র।

পরিশেষে বলতে চাই, দেহ থাকলে যেমন রোগ হয়। তেমনই অর্থনৈতিক প্রপঞ্চতে মাঝেমধ্যে নেতিবাচক কিছু ঘটতে পারে; তাতে হতাশ হওয়ার কোনো কারণ দেখি না। আর এত খারাপ অবস্থা হয়নি যে বিশ্ব ব্যাংকের বাজেটরি সাপোর্ট বা আইএমএফের বেইআউট প্যাকেজের সাহায্য নিতে হবে। তবে সংশ্লিষ্ট সবাই যদি সচেষ্ট ও আন্তরিক হয়, তাহলে সমস্যা কেটে যাবে, তা কেবল সময়ের ব্যাপার। কেননা এ সংকট কাটার মতো যথেষ্ট পজিটিভ ভ্যারিয়েবল এ দেশে আছে। বস্তুত বিগত দুই বছর ধরে ডলারের সংকট চলছে। হয়তো এখন কিছুটা বেশি হয়েছে। বর্তমানে ক্রলিং পেগ চালু হলেও এটি সাময়িক। হয়তো কিছু দিনের মধ্যে ডলারের দাম পুরাপুরি মুদ্রা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে বলে অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয়। যাহোক দোস্ত আজিজ, কষ্ট করে যে আমার বাসায় এসেছো, তার জন্য আমি যারপরনাই খুশি হয়েছি। ও হ্যাঁ, তোমার জন্য এক হাজার ডলারের ব্যবস্থা করেছি। ফার্মগেটের মানি এক্সচেঞ্জার থেকে নিয়ে যেও। ধন্যবাদ আজিজ আবার আসবে। আশা করি কলকাতা থেকে সুস্থ হয়ে ফিরবে, ইনশাআল্লাহ।

লেখক: গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত

বিষয়:

banner close